শিশুসন্তানের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য মস্তিষ্কের সামনের অংশ মায়েদের মতো বাবাদেরও একইভাবে সক্রিয় হয়
শিশুসন্তানের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য মস্তিষ্কের সামনের অংশ মায়েদের মতো বাবাদেরও একইভাবে সক্রিয় হয়

মতামত

বড় হলেও বাবাদের ছোঁয়া যায় না

বছর তিনেকের এষা। লন্ডনে আমাদের পাড়াতেই বাড়ি। আমার মেয়ের সঙ্গে একই স্কুলে যায়। হঠাৎ করেই একদিন শুনি এষা অসুস্থ। হাসপাতালে নিতে হবে। ভাবলাম দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে। মাস পেরিয়ে যায়। অসুস্থতা বাড়তে থাকে। বিশেষায়িত বড় হাসপাতালে নেওয়া হয়। এষার বাবা নাদেশের সঙ্গে একদিন দেখা। দুরারোগ্য লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত এষা। কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে। নাদেশ ফোন থেকে এষার ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখো, হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, উচ্ছল আমার মেয়েটার আজ কী অবস্থা। একদম বিছানাবন্দী। উঠতে পারে না। হাঁটতে পারে না। নিজে থেকে খেতে পারে না। আমি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় বাবা।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘এষা ঠিক হয়ে যাবে।’

কিছুদিন পর খবর পেলাম প্রথম কেমো কাজ করেনি, দ্বিতীয় কেমো দেওয়া হবে। বড়রাই কেমোর ধকল নিতে পারে না, ছোট্ট মেয়েটি কীভাবে পারবে ভাবছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্বিতীয়বারও কাজ করল না কেমো। ডাক্তার বলেছেন, স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করে দেখা যেতে পারে। শেষ অবলম্বন। স্টেম সেল খুঁজে পেতে দাতার প্রয়োজন। দাতা পেলেই হবে না; ম্যাচ করতে হবে। হাতে সময় খুব কম। নাদেশ পরিচিতজনদের কাছ থেকে নমুনা নিলেন। স্টেম সেলদাতাদের ব্যাংকগুলোয় ছুটলেন। নমুনা নেওয়া হলো। ম্যাচ করল না। জানা গেল, গড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা গেলে এষার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাচ পাওয়ার গাণিতিক সম্ভাবনা আছে। এত মানুষের নমুনা, খুব অল্প সময়ে জোগাড় করে পরীক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব। নাদেশরা জাতিগতভাবে ব্রিটিশ শ্রীলঙ্কান। অর্থাৎ দক্ষিণ এশীয় দাতাদের নমুনা ম্যাচ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

১৯৬৬ সাল। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবি মুক্তি পেয়েছে। চারদিকে প্রশংসা। একের পর এক অসাধারণ সব ছবি তৈরি করছেন সত্যজিৎ। নতুন ছবি ‘চিড়িয়াখানা’-এর শুটিং শুরু হয়েছে। শুটিং চলাকালে সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র সন্তান কিশোর সন্দীপ রায় বাবার কাছে বায়না ধরলেন ছোটদের নিয়ে ছবি করার। ছোটদের জন্য ছবির গল্প খোঁজা শুরু হলো। গল্প পাওয়া গেল। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ‘গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ছবি বানানোর জন্য জগৎ-জোড়া যাঁর নাম, সেই সত্যজিৎ রায়ও ছেলের আবদার ফেলতে পারলেন না।

নাদেশ অভিনব পন্থা নিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা শুরু হলো। স্কুল, মন্দির ও পাড়ার ক্লাবে গিয়ে অনুরোধ করলেন অস্থায়ী নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র খোলার, যাতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করা যায়। সন্তানের জন্য বাবার এই আর্তিতে অনেকেই এগিয়ে এলেন। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে, করোনার মধ্যেও মানুষ নিয়ম মেনে তাঁদের নমুনা দিয়ে এলেন। পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত ম্যাচ। সাফল্যের সঙ্গে স্টেম সেল এষার অস্থিমজ্জায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এষা বাড়ি ফিরে এসেছে।

বছরজুড়ে হাসপাতাল, বাড়ি, অন্য সন্তানদের দেখাশোনা, আর কাজ। নাদেশ হার মানেননি। তাঁর এ প্রচেষ্টায় বিলেতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ এশীয় স্টেম সেলদাতাদের এক বিশাল ব্যাংক। সন্তানের জন্য সাধারণ বাবাও মাঝেমধ্যে অসাধারণ হয়ে ওঠেন।

২.

নিউইয়র্কে ট্যাক্সিতে ওঠামাত্রই চালক বললেন, ‘আমি কফি খাচ্ছি। মনে কিছু কোরো না, দুঃখিত।’ ‘আমি কফি খেয়েই হোটেল থেকে বের হয়েছি,’ হেসে দিয়ে বললাম। কাজের তাগিদে প্রায় দিনই সাতসকালে উঠে আমাকে ট্যাক্সি নিতে হয়। গোমড়া মুখে বসে থাকার চেয়ে নতুন শহরে, নতুন দেশে ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে গল্প করতে আমার খারাপ লাগে না। সাতসকালেও যানজট। চালক দেখলাম এই যানজটের মধ্যে ফ্লাস্ক থেকে আবারও কফি ঢেলে নিলেন।
‘আসলে রাতে অনেকক্ষণ কাজ করি তো, সে জন্য সকালে একটু বেশি কফি খাই। ক্লান্তি আসে না।’
‘রাতদিন সারাক্ষণ ট্যাক্সি চালানো তো বেশ কষ্টের কাজ,’ বললাম।
‘আমি দিনে ট্যাক্সি চালাই আর রাতে পেট্রল স্টেশনে কাজ করি।’
‘কত ঘণ্টা কাজ করো দিনে?’
‘সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা।’
‘পুরো সপ্তাহ, না পাঁচ দিন?’
‘পুরো সপ্তাহ। ১৫ বছর ধরে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে আসছি।’
মনে মনে ভাবলাম, বলে কী লোকটা! কিছুটা চিন্তিতও হলাম।
‘তুমি চিন্তা কোরো না, তোমাকে ঠিকমতো এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেব।’

আলাপে জানলাম, লুই গঞ্জালেজ মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশী। তিন সন্তান আর স্ত্রী মেক্সিকোতে থাকেন। সন্তানেরা অত্যন্ত মেধাবী। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজন নামকরা স্কুলে। লুই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর জন্য বছরের পর বছর ধরে একাধিক কাজ করে চলেছেন। ১৫ বছর সন্তান আর স্ত্রীর মুখ দেখেনি। বৈধ কাগজ না হওয়া পর্যন্ত লুই একবার আমেরিকা ছাড়লে পুনরায় ঢোকা অনিশ্চিত।

কয়েক বছর আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা রাজমিস্ত্রি প্রকাশ ও অশোকের গল্পটাও একদম একই রকম। শুধু দেশ আর পেশাটা ভিন্ন। কিন্তু গল্পটা সেই বাবাদেরই। সন্তানের জন্য বিদেশ-বিভুঁইয়ে সবাইকে ছেড়ে এক কামরার ঘরে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে যুগের পর যুগ ধরে কাজ করা বাবাদের সংখ্যা অগণিত।

৩.

১৯৬৬ সাল। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবি মুক্তি পেয়েছে। চারদিকে প্রশংসা। একের পর এক অসাধারণ সব ছবি তৈরি করছেন সত্যজিৎ। নতুন ছবি ‘চিড়িয়াখানা’-এর শুটিং শুরু হয়েছে। শুটিং চলাকালে সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র সন্তান কিশোর সন্দীপ রায় বাবার কাছে বায়না ধরলেন ছোটদের নিয়ে ছবি করার। ছোটদের জন্য ছবির গল্প খোঁজা শুরু হলো। গল্প পাওয়া গেল। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ‘গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ছবি বানানোর জন্য জগৎ-জোড়া যাঁর নাম, সেই সত্যজিৎ রায়ও ছেলের আবদার ফেলতে পারলেন না।

সত্যজিৎপত্নী বিজয়া রায় নিজের আত্মজীবনীতেই এসব লিখেছেন।

নিজের সন্তানকে বিনা অপরাধে জেলে বন্দী দেখে ভেঙে পড়েছিলেন শাহরুখ খান। সাধারণ বাবার মতো নিজের ছেলের কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে কখনোই পিছিয়ে থাকেন না অমিতাভ বচ্চনও। অসাধারণ বাবারা সন্তানের জন্য অনেক সময় সাধারণ হয়ে যান।

৪.

আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে। ঢাকা থেকে নড়াইল যেতে বাসে সময় লাগত ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে ধুলো মেখে বাড়ি ফিরলে আমাকে চেনা যেত না। আমার বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, যাতে আমার এই ভ্রমণ একটু আরামের হয়। আমাকে ঘামতে না হয়। অথচ আমার এই বাবা প্রচণ্ড গরমে দিনের মধ্যে অন্তত সাত ঘণ্টা কোট, টাই আর তার ওপর কালো গাউন চাপিয়ে বছরের পর বছর কাজ করে বাড়ি ফিরতেন গলদঘর্ম হয়ে। আমাকে আরেকটু ভালো রাখার আমার বাবার সেই চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যত নয়। কাব্যিকও নয়। এ বিষয়ে কবি-সাহিত্যিকদের আগ্রহও অপেক্ষাকৃত কম।

তবে সাম্প্রতিক একাধিক বিজ্ঞান গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পিতৃত্বের জন্য বাবাদের শরীরেও অনেক পরিবর্তন আসে। সন্তান জন্মের পরদিন থেকেই নতুন বাবাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের পরিমাণ কমতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর কারণে সন্তানের প্রতি বাবাদের মনোযোগ, আকর্ষণ এবং সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সন্তান জন্মদানের পর মায়ের মতো বাবার শরীরেও বেড়ে যায় অক্সিটোসিনের মাত্রা।

অক্সিটোসিনকে বলা হয় ভালোবাসার হরমোন। সম্পর্ক তৈরিতে, বিশেষ করে শিশুদের সঙ্গে মা-বাবার ঘনিষ্ঠতার জন্য অক্সিটোসিনের ভূমিকা রয়েছে। দেখা গেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের সঙ্গে বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলে বাবার শরীরে অক্সিটোসিনের মাত্রা বেড়ে যায়।

সন্তান জন্মের পর বাবাদের শরীরে স্ট্রেস হরমোন করটিসলের পরিমাণ বেড়ে যায়, যাতে শিশুদের কোনো বিপদে দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়। মস্তিষ্কেও একধরনের পরিবর্তন হয়। শিশুসন্তানের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য মস্তিষ্কের সামনের অংশ মায়েদের মতো বাবাদেরও একইভাবে সক্রিয় হয়।

সব বাবার জন্য ভালোবাসা।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
Subratabose01@yahoo.com