প্রতিদিন নয়, প্রতিমুহূর্তে বিদেশ থেকে দুঃসংবাদ আসছে। করোনাভাইরাস প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। অনেকে কাজ হারিয়ে দিশেহারা। কেউ কেউ আক্রান্ত স্বজনদের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। আবার অনেকে ‘শোক সংবাদ’ হয়ে গেছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ১৩১ জন, যুক্তরাজ্যে ৪৮, ইতালিতে ৬ জন, কানাডায় ৪ জন, সৌদি আরব ও স্পেনে ৩ জন করে, কাতারে ২ জন এবং সুইডেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় ১ জন করে মারা গেছেন। কেবল সিঙ্গাপুরে ৬৬৯ জন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত।
একটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি পরিবার। দেশে থাকা স্বজনেরা। প্রবাসে মানুষের জীবন খুব কষ্টের। করোনাভাইরাস সেই কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না কী করবেন।
জঙ্গিদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে।’ আমরা সবাই এখন মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে আছি। অদৃশ্য করোনাভাইরাস কখন কার দিকে হানা দেবে, এক সেকেন্ড আগেও কেউ জানি না।
অনেকের অভিযোগ করেন, প্রবাসীদের কারণেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কথাটি সত্য নয়। চীনে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটার পর যখন সেখান থেকে দলে দলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ফিরে এলেন, চীনা নাগরিকেরা এলেন, তখন কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। কেননা সরকার সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। চীনফেরত প্রত্যেকের শরীর পরীক্ষা করে কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
পরে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকেরা আসতে থাকলে সংশ্লিষ্টরা পরীক্ষার কথাটি ভুলে গেলেন। কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা ভুলে গেলেন। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই অনেককে ছেড়ে দিয়েছিল। ওই সময়ে শুধু প্রবাসীরা বাংলাদেশে আসেননি। যাঁরা বিদেশে বেড়াতে বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, তাঁরাও এসেছেন। এসেছেন অনেক বিদেশি নাগরিকও। তাই, দেশে করোনা ছড়ানোর জন্য প্রবাসীদের দায়ী এ কথা বলা যাবে না। এ জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা।
করোনাকালে আমরা কেউ ভালো নেই। দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে। পার্থক্য হলো, দেশের ভেতরে থাকলে অন্তত ভিসার মেয়াদের জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বাইরে সেটিও করতে হয়। করোনায় প্রবাসীরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে হারানোর পথে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক বেতন অর্ধেক করে দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের সহায়তা কর্মসূচিতে তাঁদের জায়গা হয়নি, প্রবাসী কল্যাণ তহবিল থেকে যে সাড়ে চার শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
সরকার কয়েক দফায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে ধনী শিল্পমালিক থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষও আছেন। আছেন চিকিৎসক–স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু প্রাবাসীরা নেই। অথচ প্রবাসীদের অবদানের কথা বলতে বলতে মন্ত্রী–নেতারা মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। যে প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চলনশক্তি, যাঁরা বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান, তাঁদের জন্য কোনো সহায়তা কর্মসূচি নেই!
বৈদেশিক জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মতে, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ২২ থেকে ২৩ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। দেশে তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। এ কারণে জমিজমা বিক্রি কিংবা ধার–দেনা করে তাঁরা বিদেশে যান। পদে পদে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হন। যে কাজের কথা বলে তাঁদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই কাজ দেওয়া হয় না। মজুরি দেওয়া হয় কম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। রাষ্ট্র ও মালিকের অমানবিক আচরণ। তারপরও দেশে থাকা স্বজনদের কথা ভেবে এই মানুষগুলো বিদেশে থেকে আমাদের অর্থনীতিকে পুষ্ট করছেন।
লকডাউন কিংবা কারফিউর কারণে এই মানুষগুলো এখন কার্যত গৃহবন্দী। দেশে স্বজনদের টাকা পাঠাবেন কী, নিজেরাই চলতে পারছেন না। একাধিক দেশে থেকে প্রবাসীদের মানবিক বিপর্যয়ের খবর আসছে। পত্রিকায় দেখলাম, সরকার মালদ্বীপে অবস্থানকারী প্রাবাসী শ্রমিকদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে নৌবাহিনীর জাহাজে।
সিঙ্গাপুরে আটকে পড়া শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু অন্যান্য দেশের বিপদগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের কী হবে? প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ টাকায় কতজন প্রবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে?
প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যারা অস্থায়ী কিংবা চাকরি শেষে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাঁরা বেশি নাজুক অবস্থায় আছেন। কারও কারও ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। সরকার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে, লকডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন তাঁদের হয়রানি করা না হয়। সৌদি আরবসহ অনেক দেশই সেটা মেনে নিয়েছে।
কিন্তু রোজগার বন্ধ হওয়া মানুষগুলো খাবে কী? সরকার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে প্রবাসীদের সহায়তা করার জন্য। এ জন্য বিভিন্ন মিশনে কিছু অর্থও দেওয়া হয়েছে। মিশনগুলো হটলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রবাসীদের ঠিকানা দিতে বলেছে, যাতে তারা খাবার পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু বরাদ্দ টাকায় প্রয়োজনের এক–দশমাংশও মিটবে না। আবার লকডাউনের জন্য সবার কাছে পৌঁছানোও সম্ভব হবে না। এসব প্রবাসী শ্রমিক ধারদেনা করে এক–দুই মাস হয়তো চলতে পারবেন। কিন্তু সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে কী হবে? করোনা সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আরও বেশি সংকটে পড়বে। তাদের অর্থনীতি স্থবির হবে। যে প্রবাসী শ্রমিকদের আয় আমাদের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করেছিল, সেই শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসতে হতে পারে। ইতিমধ্যে যেসব শ্রমিকের পক্ষে দেশে টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না, তাঁদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো কীভাবে চলছে, সেই খোঁজ কেউ নিচ্ছেন না। এ রকম পরিবারের সংখ্যা হবে কয়েক লাখ।
বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিকেরা ফেসবুকে এবং বন্ধু ও স্বজনদের কাছে টেলিফোন করে তাঁদের দুরবস্থার কথা জানিয়েছেন। কেউ দেশ ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছেন। কেউ দ্রুত খাদ্যসহায়তা পাঠানোর কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রবাসীদের সমস্যাটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। নিলে সমস্যার শুরুতে বিদেশে বিপদাপন্ন শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত।
এখন তাঁরা দুটি কাজ করতে পারেন। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এ কথা বোঝানো যে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। তাঁরা ওই সব দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছেন। বিপদের সময় তাঁদের সঙ্গে মানবিক আচরণই করতে হবে। এই মুহূর্তে জরুরি কাজ ও আশ্রয় হারানো শ্রমিকদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। আর যেসব প্রাবাসী শ্রমিক দুরবস্থায় আছেন, দেশে থাকা তাঁদের স্বজনদের কাছে দ্রুত সহায়তা পৌঁছানো। প্রবাসী শ্রমিকেরা যেমন কষ্টে আছেন, তেমনি কষ্টে আছেন তাঁদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরাও।