মতামত

ব্রিটেনের গরিব আইন ও বাংলাদেশিদের গরিবি

টিসিবির ট্রাক আসেনি কিন্তু ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কেনার জন্য রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে শ দেড়েক মানুষ। রাজধানীর খামারবাড়ি থেকে সম্প্রতি তোলা।
ছবি: আশরাফুল আলম

তৎকালীন আর্থসামাজিক বাস্তবতায় ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেট ব্রিটেনের পার্লামেন্টে গরিব আইন (দ্য পুওর রিলিফ অ্যাক্ট, ১৬০১) পাস হয়। আইনটি ওই সময়কার ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের (৪৩তম) নামানুসারে ‘রানি এলিজাবেথ-এর গরিব আইন’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ওই আইনের মূল কথা ছিল দরিদ্রদের দারিদ্র্য বিমোচন এবং দারিদ্র্যের কষ্ট লাঘবে সহায়তা করা। দরিদ্রদের সহায়তার লক্ষ্যে সেখানে দুই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যথা (১) ঘরে (ইনডোর) এবং (২) বাইরে (আউটডোর) প্রকল্প। এসব প্রকল্পে প্রচুর কারখানা (ওয়ার্ক হাউস) নির্মাণ করা হয় এবং কারখানার বাইরেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ দেওয়া হয়। ইনডোর সহায়তা হিসেবে গরিবদের খাদ্য, নগদ অর্থ এবং পরিধেয় বস্ত্র সহায়তা করা হতো। অনেক সময় ইনডোর কারখানা স্থাপনে অতিরিক্ত ব্যয় হলে আউটডোর প্রকল্পে কর্মসংস্থানে বেশি জোর দেওয়া হয়।

ব্রিটেনের গরিব আইনে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দরিদ্রদের মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথমত, অক্ষম জনগোষ্ঠী। অক্ষম জনগোষ্ঠী কাজ করতে অপারগ। সমাজের অন্ধ, বধির, খোঁড়া, বিকলাঙ্গ থেকে শুরু করে অতিবৃদ্ধ এবং বয়স্কা বিধবারা অক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হয়। এসব জনগোষ্ঠীর আবাসনের জন্য ‘গরিব আবাসন প্রকল্প’ বা ‘পুওর হাউস’ নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষম কিন্তু কর্মহীন। এ ধরনের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের কারখানা নির্মাণ করা হয়। যেহেতু এ শ্রেণির কর্মহীন গরিবেরা কর্মক্ষম, তাই তাদের নির্ধারিত কারখানার বাইরেও নিয়োজিত হতে উৎসাহিত করা হতো। তৃতীয় শ্রেণিতে অলস ভবঘুরে শ্রেণির লোকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এসব লোকজন কর্মক্ষম এবং চাইলে কাজ পেতে পারে। কিন্তু নানা কারণে তারা কাজ না করে বেকার থাকত, অনেকে নেশাগ্রস্ত হয়ে সমাজে বিভিন্ন অনাচারেও লিপ্ত হতো। এ ধরনের লোকজনকে ধরে ধরে বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্র এমনকি জেলে পুরে সংশোধন সাপেক্ষে কাজে নিয়োগের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চতুর্থ পর্যায়ে এমন বাল্য বয়সীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যারা চাইলে তাদের অসহায় পিতা-মাতার ভরণপোষণে দায়িত্ব নিতে পারে। এই কম বয়সী ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

উল্লিখিত চার ধরনের লোকজনের মধ্যে প্রথমোক্ত বা অক্ষম জনগোষ্ঠীর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। সরকার তাদের আশ্রয়ণ এবং দেখভালের দায়িত্ব ‘প্যারিশ’ সংগঠনগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। কথিত প্যারিস সংগঠন বলতে ব্রিটেনে সে সময়ের সামাজিক এবং জনহিতকর চার্চকে বোঝানো হতো। এসব জনহিতকর ‘প্যারিশ চার্চ’ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত দরিদ্র পল্লিতে বসবাসরত অক্ষম জনগোষ্ঠীর রুটিরুজির সমন্বয় করত। তাদের দেওয়া রুটিরুজি সে সময়ে ‘প্যারিশ লোফ’ বা প্যারিস রুটি নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায় পরিক্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে এ দেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এ দেশে বহুবিধ সমস্যার অন্যতম দারিদ্র্য। সঙ্গে বেকারত্ব তো আছেই।

সাধারণভাবেই এ দেশে দারিদ্র্য সমস্যা প্রকট। দারিদ্র্য যদিও একটি আপেক্ষিক বিষয় কিন্তু যেকোনো মানদণ্ডেই বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং তাদের দারিদ্র্যের পরিমাণ বাড়ছে। করোনা মহামারি দারিদ্র্য সমস্যায় আগুনে ঘৃতাহুতির ন্যায় কাজ করছে। শুধু গ্রাম নয়, শহরাঞ্চলেও দরিদ্রের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। মহানগরের রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, বাজারে, পার্কে সব জায়গায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আনাগোনা বাড়ছে।
এসব দরিদ্র মানুষের অনেকেই গ্রাম থেকে কাজের আশায় শহরে ছুটে এসেছে।

শহরের বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর বস্তি, সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের প্রাঙ্গণ, রাস্তার ফুটপাত ইত্যাদিই তাদের প্রথম আবাস। সেখানে তারা না পায় খাদ্য, না চিকিৎসা এমনকি ন্যূনতম পয়ঃপরিষ্কারের সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষুকের আনাগোনা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ভিক্ষুকদের অনেকে অতিরিক্ত সহানুভূতির আশায় তাদের বিকলাঙ্গ হাত-পা, চোখ-মুখ ইত্যাদি প্রদর্শন করে ভিক্ষা চায়। বীভৎস সে দৃশ্য ব্যস্ত শহুরে জনজীবনে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। বিশেষত, রাস্তাঘাটে চলাচল করা কোমলমতি শিশু, নারী, বয়স্ক মানুষজন, ছাত্রছাত্রীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এই অক্ষম-বিকলাঙ্গদের পাশাপাশি অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আজকাল শহরে নানা বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা রাস্তায় ভিক্ষা বা অনেকটা চাঁদাবাজির চেষ্টা করে। পাড়া-মহল্লায় তারা অনেক সময় মানুষকে জিম্মি করে অর্থ ও মূল্যবান জিনিস আদায় করে।

ব্যস্ত শহরের রাস্তাঘাটে দৃশ্যমান এসব ভিক্ষুক বা হাত পেতে জীবনযাপনকারী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এমন অনেকে আছে, যারা ভিক্ষাও করতে পারে না। অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মারাত্মক রোগে ভোগা বিকলাঙ্গ মানুষ, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিরা চাইলেও ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে পারে না। এসব জনগোষ্ঠী সত্যিকার অর্থে গরিবের ভেতর আরও গরিব। শহরে বস্তিতে বসবাসকারী নারীদের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারের পুরুষ সদস্যটি চাইলে বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে, কিন্তু ঘরে অবস্থিত নারী সদস্য এবং ছোট ছোট শিশুরা অনাহারীই থেকে যায়। অনেক সময় দেখা যায় এসব ছিন্নমূল পরিবারের পুরুষ সদস্য স্ত্রী-ছেলেমেয়ে রেখে অন্যত্র ভেগে যায় এবং সেসব ক্ষেত্রে নারী সদস্যটি অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত হয়। মা হিসেবে সে হয়তো ছেলেমেয়ে ছেড়ে কোথাও যেতেও পারে না, আবার কষ্টও সহ্য করতে পারে না।

শহর জীবনের বাইরে গ্রামগঞ্জেও অনেকে হতদরিদ্র আছে। কেউ কর্মহীন বিধবা, এতিম অনাথ শিশু ছেলেমেয়ে, বিকলাঙ্গ সন্তানাদি নিয়ে অনেক পরিবার আছে, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সাহায্য প্রত্যাশী থাকে। এ শ্রেণির অনেক মানুষ আছে, যারা পাড়াপ্রতিবেশী বা নিকট আত্মীয়স্বজনের করুণা নিয়ে বেঁচে থাকে, যা অনেককেই হীনম্মন্যতায় ভোগায়।

শহর তো বটেই, গ্রামগঞ্জে আর একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা নিতান্তই অলস প্রকৃতির। ভবঘুরে এসব মানুষ কাজের সুযোগ থাকলেও কাজ করে না। গ্রামগঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় এরা অলস সময় কাটায়। বয়স্কদের পাশাপাশি উঠতি বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সমাজ তো বটেই, দিন শেষে তারা পরিবারের জন্য বিরাট ঝুঁকি এবং বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। এ শ্রেণির অনেকে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ, লোক ঠকানো, চুরি, ছিনতাই, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণের মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

আবার বাংলাদেশেও অনেক উঠতি তরুণ ছেলেমেয়ে পাওয়া যাবে, যারা কাজ করে জীবন ধারণ এবং স্বীয় পরিবারকে সাহায্য করতে চায়। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে সাহায্যকারী এসব ছেলেমেয়ে অনেকেই তাদের ক্ষুদ্র উপার্জন থেকে তাদের নিজেদের প্রয়োজন মেটায় আবার পরিবারেও অবদান রাখে।

প্রশ্ন হলো, আজ থেকে ঠিক চার শ বছর আগে, ১৬০১ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পাস হওয়া কথিত গরিব আইন বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে কীভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে? সমাজ সংস্কৃতি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আজ ব্রিটেনের যে অবস্থান, ঠিক কয়েক শ বছর পূর্বে তা ছিল না। সে সময়কার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং বিরূপ আবহাওয়ার দেশ গ্রেট ব্রিটেন মূলত নানা শ্রেণির দরিদ্রদের সহায়তার জন্য গরিব আইন প্রবর্তন করেছিল। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছে, তা অনস্বীকার্য। এ দেশের মাথাপিছু আয় পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী মজুত আছে, রপ্তানি আয় ঊর্ধ্বমুখী, অনেক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হচ্ছে এসব যেমন ঠিক, সঙ্গে সঙ্গে প্রকট আয়-বৈষম্য, শহর ও গ্রামীণ জীবনের সীমাহীন পার্থক্য, দুর্নীতি, বসবাস অযোগ্য মেগা সিটি ইত্যাদিও এক রূঢ় বাস্তবতা।

সীমিত সম্পদ দিয়ে সীমাহীন অভাব পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে নীতিনির্ধারণী মহলকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি প্রভূত ক্ষেত্রে সমাজে বিভাজন প্রকট। এ দেশেরই একশ্রেণির মানুষ বিদেশি আমদানি করা বিলাসী পণ্য, ছেলেমেয়েদের বিদেশে শিক্ষা দীক্ষা বা দেশে থাকলেও বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি শিখিয়ে থাকেন। সুচিকিৎসার জন্য তাঁরা বিদেশমুখী। আবার নেহাতই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা এবং মৌলিক শিক্ষার জন্য সংগ্রামী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। করোনার কারণে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে, পরিবার-পরিজন নিয়ে শহর ছাড়ছে, ভাগ বসাচ্ছে গ্রামের সীমিত সম্পদে।

লকডাউনের সময়েও বড় শহরের ব্যস্ত রাস্তায় নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড়, মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর টিসিবির গুদামের লাইন দিন দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করোনা মহামারির এ সময়ে আমাদের সমাজেরই অংশ সেই সব অক্ষম জনগোষ্ঠী, ভবঘুরে, বেকার, এতিম, অনাথ শিশুদের সম্পর্কে একটু আলাদা করে ভাবা দরকার। মনে রাখতে হবে, রাস্তায় ত্রাণ বিতরণ এবং সেই ত্রাণের সঠিক জায়গায় পৌঁছানো এক কথা নয়। তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের গরিব আইন বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় দীর্ঘ মেয়াদে না হলেও স্বল্প মেয়াদে প্রয়োগের চিন্তা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে কথিত উন্নয়নের ন্যূনতম অংশও যদি এসব গরিব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো যায়, তাহলে উন্নয়ন এবং উন্নয়নকারী উভয়েরই সার্থকতা বলে মানব ইতিহাসে পরিগণিত হবে।

ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।