স্কটল্যান্ডের এডিনবরা ক্যাসেল দুর্গের প্রবেশদ্বারে দুটি বিশাল মূর্তি। একটি রাজা রবার্ট ব্রুসের, অন্যটি স্কটল্যান্ডের জাতীয় মাসকট, দাঁড়ানো সিংহের। ট্যুর গাইড সেখানে পর্যটকদের দাঁড় করিয়ে বললেন, এটি আমাদের জাতীয় বীর রবার্ট ব্রুসের মূর্তি, যিনি স্কটল্যান্ডকে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধ করেছিলেন। সর্বশেষ ১৩১৪ সালে ব্রুস ইংরেজদের পরাজিত করে স্বাধীন স্কটল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলজীবনে এসব ইতিহাস পড়তে হতো। শিরোনাম ছিল ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’। ব্রুস স্কটল্যান্ডকে স্বাধীন করার আগে সাতবার ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। দাঁড়ানো সিংহটি সম্পর্কে গাইড বলেন, এটি স্কটল্যান্ডের সিংহ, সব সময় দাঁড়ানো; আর ইংরেজদের সিংহ সারা জীবন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল। শহরের মাঝখানে স্কটল্যান্ডের জাতীয় পার্লামেন্ট। সদর দরজা বন্ধ। সামনে কেউ একজন লিখে দিয়েছেন, একদিন যখন স্কটল্যান্ড স্বাধীন হবে, এই দরজা খুলবে। এসব ১৯৮৯ সালের কথা। এর মধ্যে নিশ্চয় অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তবে যে পরিবর্তনটির জন্য এক বিরাটসংখ্যক স্কট জনগোষ্ঠী সেই ১৭০৭ সাল থেকে অপেক্ষা করছে, সেটি তারা নিজেরাই ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক গণভোটে খারিজ করে দিল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়ে। স্বাধীনতার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৫ শতাংশ আর বিপক্ষে ৫৫ শতাংশ। ১৯৭৯ সালেও এমন এক গণভোটে মাত্র ২৭ শতাংশ পক্ষে পড়েছিল। ৪০ শতাংশের বেশি না হলে সেই ভোটের কোনো গুরুত্ব থাকে না। ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড এক চুক্তির বলে দুই দেশকে এক করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে স্কটল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যের অংশ। সঙ্গে আছে ওয়েলস আর উত্তর আয়ারল্যান্ড। তারাও স্বাধীন হতে চায়, কিন্তু তাদের চাহিদা স্কটদের মতো জোরালো নয়। আয়ারল্যান্ডের একটি অংশ আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে।
ইংরেজদের তুলনায় স্কটরা অনেক বেশি সজ্জন আর ভদ্র। তাদের একটি বড় অংশ স্কটিশ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ধারণ করে। স্কটদের নিজস্ব এক পাউন্ড নোটও আছে। একসময় স্কটল্যান্ড জাহাজনির্মাণ, ব্যাংকিং, ইস্পাত, পাট প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন আর হুইস্কি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কালক্রমে বিশ্বায়নের যুগে এসব শিল্পের অধিকাংশই বর্তমানে আর স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতে তেমন কোনো অবদান রাখে না। পাট প্রক্রিয়াকরণ শিল্প অনেক আগেই পাটের নিজ দেশ বাংলাদেশ আর ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ব্যাংকিং শিল্প বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। জাহাজনির্মাণ আর ইস্পাতশিল্প অর্থনৈতিকভাবে তাদের জন্য আর লাভজনক নয়। বাকি থাকল পর্যটন আর হুইস্কি। স্কটল্যান্ড লাগোয়া উত্তর আটলান্টিক সাগরে তেলের প্রচুর মজুত আছে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ওঠানামা করার কারণে তার ওপর সব সময় নির্ভর করা যায় না। গ্রেট ব্রিটেনের বাজেটে তার অন্যান্য অঞ্চলের মতো স্কটল্যান্ডের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। সবার দাদা, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ওয়েস্টমিনস্টার যেখানে অবস্থিত, সেই ইংল্যান্ডের নিজের অর্থনীতিও তেমন একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাই স্কটরা মনে করে, তারা ওয়েস্টমিনস্টারের একচোখা নীতির কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। দিনে দিনে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। বর্তমানে সারা স্কটল্যান্ডে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশের কাছাকাছি।
স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা অ্যালেক্স স্যামন্ড ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য গণভোটের আয়োজন করবেন। স্বাধীন স্কটল্যান্ডের সম্ভাবনা অপার। গণভোটের জন্য প্রয়োজন হবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি। ২০১১ সালের নির্বাচনে স্যামন্ডের দল এসএনপি জয়ী হয়েছিল এবং স্যামন্ড গণভোটের জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের অনুমতিও আদায় করেছিলেন। ‘হাঁ’ ভোটের পক্ষেÿ ব্যাপক প্রচারও চালিয়েছিলেন। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল যে ২০১৪ সালের গণভোটও ১৯৭৯ সালের ভাগ্য বরণ করবে। কিন্তু যতই দিন যায়, ততই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অ্যালেক্স স্যামন্ড আর তাঁর পক্ষের লোকজন জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে স্কটদের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে তাদের স্বাধীন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেকটা সত্তরের বাংলাদেশ। প্রমাদ গুনলেন ডেভিড ক্যামেরনসহ রক্ষণশীল, লেবার আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের বাঘা বাঘা নেতারা। রক্ষণশীল পার্টির নেতা ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নেতা নিক ক্রেগ ছুটলেন স্কটল্যান্ডে। লেবারদলীয় নেতা এড মিলিব্যান্ড গিয়ে বলে এলেন, স্কটল্যান্ডকে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে।
এর অর্থ কী হতে পারে, তা তেমন একটা কেউ বুঝল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য বুঝি চিরদিনের জন্য অস্তগামী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এমন সময়ে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়? স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে যুক্তরাজ্য হারাতে পারে জাতিসংঘে তার স্থায়ী আসনটি। ছিটকে পড়তে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। স্কটল্যান্ড ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের অনেক কাছে। ইংল্যান্ডের পরিবর্তে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ দাবি করতে পারে। ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে না থাকলে বিদেশি পুঁজি আসাটা সহজ হবে না। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে আরও বেশি। ব্রিটেনের প্রায় সব পারমাণবিক সাবমেরিন যুদ্ধজাহাজ স্কটল্যান্ডের বন্দরে নোঙর করা। সেই সব চলে যেতে পারে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের দখলে। বিশ্বদরবারে বর্তমানে ব্রিটেনের যে খায়খাতির, তা–ও আর থাকবে না। মহাফ্যাসাদে ডেভিড ক্যামেরন আর ইংরেজ রাজনীতিবিদেরা। তাহলে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যেত না, এখন থেকে তা কি শুধু ইংল্যান্ড বা পাশের দু-একটা এলাকার ওপরই দেখা যাবে? ঠিক এমনটি হয়েছিল শেষ মোগল সম্রাটের আমলে? তখন মোগল সাম্রাজ্য দিল্লির লাল কেল্লার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। শেষমেশ একদা সুপার পাওয়ার ব্রিটেনের অবস্থাও কি তাই হবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এমন মহাসংকটে আর পড়েনি। সব দলের নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন, স্কটল্যান্ডের প্রতি অবিচার তো হয়েছেই, তা অস্বীকার করি কীভাবে? কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আর হবে না ।
চতুর ইংরেজদের সঙ্গে সহজ-সরল স্কটরা পারবেন কেন? ইংরেজরা স্বাধীনতাকামী স্কটদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিল, তোমরা স্বাধীন হতে পার, তবে বর্তমানে ব্রিটেনের যে বিশাল ধার-দেনা আছে, তার আনুপাতিক ভার তোমাদের নিতে হবে। স্পেন জানিয়ে দিল, স্বাধীন স্কটল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চেষ্টা করলে তারা বাধা দেবে। স্পেনের একটি অংশের স্বাধীনতার দাবি আবার বহু পুরোনো। তেমন অবস্থা ফ্রান্সেরও। ওবামা খবর পাঠালেন, স্বাধীন স্কটল্যান্ড কখনো না। ইংরেজরা ঠিকই জানে কাকে দিয়ে সুতা টানালে কী কাজ হয়। তা না হলে কি তারা ভারতবর্ষে ২০০ বছর রাজত্ব করতে পারত? যুক্তরাজ্যে ১৭ সেপ্টেম্বরের রাতটি ছিল দীর্ঘতম রাত। বেঁচে থাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ সূর্যটা কি কাল উদয় হবে? স্বাধীনতার পক্ষেÿ স্কটরা মনে করল, কালকেই পরাধীন স্কটল্যান্ডের শেষ সূর্যোদয় হবে। না, কারও প্রত্যাশা সত্য হলো না। ইংরেজদের চাতুর্যের কাছে হেরে গেল স্কটদের সব প্রস্তুতি। ১৮ তারিখ রাতে যখন ভোট গণনা শেষ হলো, দেখা গেল ৫৫ শতাংশ স্কট নিজ দেশের স্বাধীনতা চায় না। শেষ মুহূর্তে তারা ঘাবড়ে গিয়ে থাকতে পারে। কীভাবে পরিশোধ হবে তাদের ভাগের এত বিশাল দেনা? স্বাধীন হলে তো তাদের প্রতি ইংরেজদের আচরণ আরও বৈরী হয়ে যেতে পারে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ না পেলে তাতে ঘটতে পারে বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয়। ১৯ তারিখ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের হাসিমুখে স্বস্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘আমরা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী।’ পরাজয় মেনে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার ও স্বাধীনতাকামীদের নেতা অ্যালেক্স স্যামন্ড তাঁর মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইতিমধ্যে ইস্তফা দিয়েছেন।
১৮ তারিখের নির্বাচন ইংল্যান্ডে তথা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ওয়েস্টমিনস্টারের জন্য হতে পারত একটি অশনিসংকেত। এবার ৫৫ শতাংশ ভোটার স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভবিষ্যতে, তা হতে পারে ১০-২০ বছর পর, এই ফলাফল উল্টে যেতে পারে যদি নির্বাচনের আগে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশ সরকার পূরণ না করে। ইংরেজরা যে সব সময় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, তা-ও নয়। নির্বাচনের আগে স্কটদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। তবে এই নির্বাচন যে ব্রিটেনকে রাজনৈতিকভাবে নড়বড়ে করে দিল, তা অনেক বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন। সেই প্রসঙ্গে লন্ডনের বহুল প্রচারিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৯ তারিখ রাজনৈতিক বিশ্লেষক জনাথন ফ্রিডল্যান্ড লিখেছেন, ‘স্কটল্যান্ড একটি অসাধারণ বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। ওয়েস্টমিনস্টার যেন তাকে নস্যাৎ করতে না পারে।’
এই প্রজন্ম হয়তো স্বাধীন স্কটল্যান্ড দেখে যেতে পারবে না। হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম ভিন্ন কিছু দেখতেও পারে। অনেকের প্রশ্ন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কি তাহলে অস্তাচলে? হতেও পারে। সাম্রাজ্য চিরস্থায়ী হওয়ার নজির ইতিহাসে নেই।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।