ব্রিকস থেকে ভারত কি বেরিয়ে যাবে?

সম্প্রতি ভার্চুয়াল মাধ্যমে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক ছিল চীন
ছবি : এএফপি

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও রাশিয়ার সরকার প্রধানদের নিয়ে সম্প্রতি শেষ হওয়া ব্রেক্সিট ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনটি যা হয়নি, তার চেয়ে যা হয়েছে, সে জন্যও কম কৌতূহলজনক নয়। দুদিনের এই সম্মেলনে বেশ কিছু গঠনমূলক সিদ্ধান্ত এসেছে, আবার মামুলি ও শিশুতোষ সিদ্ধান্তেরও কমতি ছিল না। বিশেষ করে সমাপনীর ‘বেইজিং ঘোষণা’ ছিল একেবারেই প্রাণহীন।

ব্রিকসের বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে অনেকের উচ্চাশা ছিল। কেননা, এ জোটে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দুটি দেশ চীন ও ভারত, সাবেক পরাশক্তি রাশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর ২০০৯ সালের বার্ষিক সভাটি ছাড়া (এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা জোটে যুক্ত হয়) এ জোটের বেশির ভাগ সম্মেলন কথার ফুলঝুরি এবং ধারাবাহিক অনার্জনের ইতিহাস।

‘বেইজিং ঘোষণা’ থেকে জানা যাচ্ছে, ‘ব্রিকস একটি উচ্চপর্যায়ের সংলাপ, যেখানে কোভিড–১৯ মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ডিজিটাল রূপান্তর, বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিম্ন কার্বন নিঃসরণের মতো বিষয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি করেছে।’ প্রকৃতপক্ষে এসব লক্ষ্য যেকোনো বহুপক্ষীয় ফোরামে আলোচিত হয়।

‘বেইজিং ঘোষণায়’ সবচেয়ে ভন্ডামির বিষয় হচ্ছে, এখানে সন্ত্রাসবাদকে দোষারোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে জাতিসংঘের যে রূপরেখা, তার অধীন ‘কম্প্রিহেনসিভ কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল টেররোরিজম’ চূড়ান্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এটা শূন্য কলসির আওয়াজের মতোই একটা ব্যাপার। কেননা, মাত্র এক দিন আগে জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা কমিটির প্রবিধানের আওতায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী আবদুর রহমান মাক্কিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা করতে চাইলে চীন তাতে ভেটো দেয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে অভিযোগ করে আসছে। কিন্তু জাতিসংঘে চীন ঢাল হয়ে দাঁড়ানোয় পাকিস্তান বারবার পার পেয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতির নাটকীয় বদল হয়েছে। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং হিমালয়ের বিতর্কিত সীমান্তে ভারতের সেনাদের বিরুদ্ধে চীনের সেনাদের বৈরী আচরণ—সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে চীনের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বড় ধরনের সন্দেহ তৈরি করেছে।

ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘জোটের সদস্যদেশগুলোর অবশ্যই একে অপরের নিরাপত্তা উদ্বেগ বুঝতে হবে এবং সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণে পরস্পরকে সমর্থন দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সংবেদনশীল বিষয়ে অবশ্যই রাজনীতিকীকরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।’

এই প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে আয়োজক দেশ চীন জোটে নতুন সদস্যদেশ অন্তর্ভুক্তের মাধ্যমে ব্রিকসকে সম্প্রসারণের একটা ভাসা–ভাসা প্রস্তাব দিয়েছে। পরে জানা গেছে, ইরান ও আর্জেন্টিনা ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, সম্মেলনে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। সমাপনী ঘোষণায় শুধু সম্ভাব্য প্রস্তাব হিসেবে বিষয়টি এসেছে।

ব্রিকস সম্প্রসারণের এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। প্রথমত, ব্রিকস বৃহত্তর অর্থে অর্থনৈতিক নাকি ভূরাজনৈতিক জোট? দ্বিতীয়ত, ব্রিকস যদি প্রাথমিকভাবে ভূরাজনৈতিক জোট হয়, তবে কি এটা চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে যে বৈশ্বিক মেরুর জন্ম হচ্ছে, সেই মেরুর নীতি বাস্তবায়ন করবে? এ ক্ষেত্রে ভারতের করণীয় কী?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগকারী সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিলের ভাষ্য থেকে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন—চার দেশের আদ্যক্ষর নিয়ে জোটটির সংক্ষিপ্ত নামকরণ ‘ব্রিক’ করেছিলেন তিনি। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটা ক্ষেত্র তৈরির তাগিদ থেকেই জোটটির যাত্রা শুরু হয়েছে। উদীয়মান চার অর্থনীতি (পরে পাঁচ) পরস্পরের বাজারে যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং সে সময়কার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতা এ ধরনের জোট গঠন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

আবার এটাও সত্য যে বৈশ্বিক উন্নয়নের গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে, সেটাও উদীয়মান এ দেশগুলোর ভাবনার সাধারণ একটি বিষয় ছিল। সে কারণে ব্রিটন উডস ইনস্টিটিউশনের মতে, এ জোট প্রতিষ্ঠার পেছনে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাও ছিল। ওয়াশিংটন প্রভাবিত উত্তর বিশ্বের বাইরে দক্ষিণ বিশ্বের প্রধান মঞ্চ হয়ে ওঠার যে আকাঙ্ক্ষা, তা থেকেই ব্রিকসের জন্ম।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতির নাটকীয় বদল হয়েছে। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং হিমালয়ের বিতর্কিত সীমান্তে ভারতের সেনাদের বিরুদ্ধে চীনের সেনাদের বৈরী আচরণ—সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে চীনের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বড় ধরনের সন্দেহ তৈরি করেছে।

ফলে ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্যটি এখন বড় ধরনের অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলেন, ব্রিকস এমন একটা মঞ্চ হবে, যেখানে ভারত তার আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পাবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতা হিসেবে ঐতিহ্যগত যে ভূমিকা ভারত পালন করে আসছিল, সেটা ব্রিকসেও রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু ব্রিকসকে যখন রাশিয়া ও চীনের স্বার্থে ভূরাজনৈতিক জোট করার এবং সম্প্রসারণের নামে ‘সমমনা’ দেশ ইরানকে যুক্ত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন সেটা ভারতের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।

ব্রিকস সম্প্রসারণের এই পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে চীন পুরোপুরিভাবে ভারতের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি। ব্রিকসকে আরও চীনকেন্দ্রিক করা হোক, সেটা ভারত চায় না। ভারতের উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, চীনের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার পরবর্তী দলে রয়েছে কি না।

ব্রিকসের যে গতিমুখ, তাতে জোট থেকে ভারতের বের হয়ে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ভারত বেরিয়ে এলে ব্রিকস আর টেকসই থাকবে না।

স্বত্ত: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: মনোজ দে

· শশী থারুর, জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী