ব্যাংকিং সুশাসন

ব্যাসেল-৩ ও আমাদের বাস্তবতা

আমেরিকার সাবপ্রাইম কেলেঙ্কারির পর ২০০৭ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকটে পতনোন্মুখ বিভিন্ন ব্যাংককে উদ্ধার করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হলে ব্যাসেল কমিটির বোধোদয় ঘটে। আপৎকালীন ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য ব্যাসেল–২-এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর যে ন্যূনতম মূলধন বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত নয়। এই উপলব্ধি থেকে ব্যাসেল–২.৫ বা ব্যাসেল–৩-এর আয়োজন। প্রথমোক্তটিতে বাজারঝুঁকির সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ট্রেডিং ব্যবসায় জড়িত ব্যাংকগুলোর পুঁজি আরও বাড়ানো হয়। শেষোক্তটিতে পুঁজি সংরক্ষণের নতুন মান নির্ধারণ করা হয়েছে, যার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটবে ২০১৯ সালে। ব্যাসেল–৩-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে: ব্যাংকের পুঁজির গুণগত মান এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ করা থেকে ব্যাংকগুলোকে বিরত রাখার জন্য ঝুঁকিভিত্তিক পুঁজির সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি তহবিলের ওপর ব্যাংকগুলোর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা (কারণ, সাবপ্রাইম সংকটের সময় এ ধরনের তহবিলই পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছিল) এবং ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য কার্যকরভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
বিশ্বকে নাড়া দেওয়া সেই আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাসেল–২-এর ব্যর্থতা নিয়ে বহু মতামত থাকলেও এ কথা ঠিক, এটি বেশ কিছু ঝুঁকিকে আমলে নেয়নি, যা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর ছিল না। এই পটভূমিতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক রণজিৎ লালের একটা মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘ব্যাসেল–২ বর্তমান বিশৃঙ্খলার সমাধান নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত কারণ।’ গ্রিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি চোরাফেস ব্যাসেল–২-এর ব্যর্থতার জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করেন: বাস্তবায়নে দীর্ঘ কালক্ষেপণ, সংশোধনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া, ঋণসক্ষমতা যাচাই করার জন্য স্বাধীন রেটিং এজেন্সির ওপর অতিনির্ভরশীলতা। তাঁর মতে, কঠোর নজরদারির নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাসেল–২ বাড়তি সুবিধা পায়নি, বরং এটির শিথিলতা ব্যাংকগুলোর জন্য পড়ে পাওয়া বলে প্রতিভাত হয়। দিমিত্রি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ব্যাসেল থ্রি, দ্য ডেভিল অ্যান্ড গ্লোবাল ব্যাংকিং-এ লেখেন, ‘সরকার ও নিয়ন্ত্রকেরা যখন দো-আঁশলা (হাইব্রিড) পুঁজির ঝুঁকিগুলো, ভুয়া ক্রেডিট রেটিং এবং বিস্বাদ আর্থিক উপকরণের মাধ্যমে ফাটকাবাজারি কর্মকাণ্ডগুলো না দেখার ভান করে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে ছিল, তখন বিরতিহীন টাকার যন্ত্রগুলো সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পূরণের পরিবর্তে নিজের স্বার্থে কাজ করে গেছে। অদ্ভুতভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ভুলে গিয়েছিল, তাদের প্রথম ও প্রধান ভূমিকা আমানত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে।’ দিমিত্রির এই খেদোক্তি যে ২০০৭-এর বিশ্ব আর্থিক সংকটকালে আমেরিকার সাবপ্রাইম উপসর্গ এবং তখনকার সরকার তথা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইঙ্গিত সেটি স্পষ্ট, কারণ তিনি ‘বিস্বাদ আর্থিক উপকরণ’ (আনসেইভারি ফিন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্ট) বলতে সেই হরিলুটের সময়কার বাহারি নামের নানা ঋণ উপকরণকেই বুঝিয়েছেন। তাই তিনি আমেরিকার গ্লাস-স্টিগাল আইনটিকে ব্যাসেল–৩-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পুনঃপ্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানানো উচিত, ১৯২৯ সালে আমেরিকার শেয়ারবাজারের মহাধস এবং পরবর্তী সময়ের মহামন্দার পর নীতিনির্ধারক মহল উপলব্ধি করেন, এই বিপর্যয়ের মূল হোতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কারণ, তারা মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম উপেক্ষা করে বেশি উত্সাহী ছিল শেয়ারবাজারে লগ্নি করতে। এমনকি নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগের পর তারা আমানতকারীদের অর্থও শেয়ারবাজারের মতো একটা ঝুঁকিবহুল খাতে বিনিয়োগ করে সীমাহীন ঝুঁকি নিয়েছিল। এ রকম কার্যকলাপ থেকে ব্যাংকগুলোকে বিরত রাখতে ১৯৩৩ সালে প্রণীত হয়েছিল গ্লাস-স্টিগাল অ্যাক্ট, যেটা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা তৈরি করা হয়। আইনটি প্রণয়নের ৬৬ বছর পর ১৯৯৯ সালে এটি বিলুপ্ত করে তার বিপরীতে নতুন আইন চালু করা হয়, যার ফলে নিজস্ব ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়। তবে ব্যাংকের বিশাল পুঁজি এবং বৃহৎ কার্যক্রম শেয়ারবাজারে অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে পারে বলে একটা সংবিধিবদ্ধ ভেদরেখা টানা হয়েছে ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মাঝখানে। এই ভেদরেখা খুব কার্যকর কিছু নয় বলেই দিমিত্রি গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহাল দাবি করেছেন। দিমিত্রি তাঁর বইতে লেখেন, ‘...নিরাপদ বাণিজ্যিক ব্যাংকিং না থাকলে ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে জমা করা তাদের টাকার নিরাপত্তা নিয়ে না পারবে আস্থাশীল হতে, না পারবে পেমেন্ট, নিষ্পত্তি, অর্থ স্থানান্তর, ক্লিয়ারিং কিংবা ঋণের ওপর নির্ভর করতে।’
এই ধরনের আর্থিক অব্যবস্থা এবং বিপর্যয় ঠেকানো বা সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মূলধন মজুত রাখতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করার জন্যই ব্যাসেল–৩ বাস্তবায়নের অবতারণা। কারণ, মূলধন ঘাটতিসম্পন্ন ব্যাংকগুলোকে করদাতাদের অর্থে উদ্ধার করার পুনরাবৃত্তি বাঞ্ছনীয় নয়। ব্যাসেল–২-এর তুলনায় ব্যাসেল–৩-এ মূলধনের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করে এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটিকে আরও সংহত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন ব্যবস্থাপত্রে মূলধন থেকে তৃতীয় স্তরের (টিয়ার-৩) মূলধনকে বাদ দিয়ে কেবল প্রথম (টিয়ার-১) ও দ্বিতীয় স্তরের (টিয়ার-২) মূলধনকে রাখা হয়েছে, যাতে প্রথম স্তরটিকে শক্তিশালী করা যায়। ব্যাসেল–৩ দলিলে প্রথম স্তরের মূলধনকে বলা হয়েছে গোয়িং কনসার্ন ক্যাপিটাল। এটির আবার দুটো অংশ, কমন ইকু্যইটি টিয়ার (স্তর) ১ এবং অতিরিক্ত (অ্যাডিশনাল) স্তর ১। প্রথমটিতে থাকবে পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, সাধারণ সঞ্চিতি ও অবণ্টিত মুনাফা (রিটেইন্ড আর্নিং) ইত্যাদি। ব্যাসেল–৩ দলিলে দ্বিতীয় স্তরের মূলধনকে বলা হয়েছে গন কনসার্ন ক্যাপিটাল। এ ছাড়া সংকটের সময় ব্যাংকগুলোর তারল্য সমুন্নত রাখার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে তারল্য সুরক্ষা অনুপাত (লিকুইিডটি কাভারেজ রেশিও) এবং নিট স্থিতিশীল তহবিল অনুপাত (নিট স্টেবল ফান্ডিং রেশিও)। প্রথমটি এক মাস ধরে চলা সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণ এবং দ্বিতীয়টি এক বছরের তারল্য মেটানোর সংস্থান রাখার ব্যবস্থা।
নতুন এই দলিলের টেকনিক্যাল খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়ে এককথায় বলা যায়, এটি এমনই এক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকগুলো নিজস্ব মূলধন দিয়েই যাতে বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে। এই সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
ব্যাসেল–৩ দলিলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে, ন্যূনতম পুঁজির অতিরিক্ত পুঁজি সংরক্ষণ ভান্ডার (ক্যাপিটাল কনজার্ভেশন বাফার), যা দিয়ে সংকটের সময় পুঁজি ঘাটতির পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া যায়। এই বাফার সৃষ্টি করতে হবে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে, যথা বিতরণযোগ্য লভ্যাংশ, নিজস্ব শেয়ার পুনঃক্রয়, কর্মচারীদের বোনাস ইত্যাদি। অন্য উৎস থেকে পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব হলে, সেটা দিয়েও এই বাড়তি বাফার সৃষ্টি করা সম্ভব। ব্যাসেল–৩ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শূন্য দশমিক ৬২৫, ২০১৭ সালে ১ দশমিক ২৫, ২০১৮ সালে ১ দশমিক ৮৭৫ ও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এই বাড়তি পুঁজি সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ব্যাংক যদি সব কটি খাতে ন্যূনতম মূলধন বজায় রেখেও উপরিউক্ত হারে বাফার রাখতে না পারে, সেই ব্যাংক কোনো নগদ লভ্যাংশ, কিংবা বোনাস দিতে পারবে না। তবে কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিয়ে বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারবে। এভাবে বিভিন্ন খাতে ন্যূনতম মূলধন এবং সংস্থান বজায় রেখে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মূলধন পর্যাপ্ততার হার হবে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৬২৫, ১১ দশমিক ২৫, ১১ দশমিক ৮৭৫ ও ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
ব্যাসেল–৩-এর অধীনে মূলধন সংরক্ষণের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার বিপক্ষে যেসব যুক্তি বিভিন্ন ব্যাংক এবং সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে, দিমিত্রি তাঁর বইতে সেগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নিছক ‘ভণ্ডামি’ আখ্যা দিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি ব্যাসেল দলিলে মূলধন সংরক্ষণের ব্যর্থতার জন্য মুখ্য অর্থ কর্মকর্তা, প্রধান নির্বাহী ও পরিচালকদের দায়ী করার বিধান না রাখার সমালোচনা করে বলেছেন, এটা করা হলে তাঁরা মূলধন পর্যাপ্ততার বাজেট এবং প্রকৃত অর্জনের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে পারবেন। ব্যাসেল–৩ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘািয়ত করার ব্যাপারেও অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এটি ‘এখনই’ বাস্তবায়ন করা উচিত। এটি বাস্তবায়নের দীর্ঘ মেয়াদ এবং অন্যান্য শিথিলতাকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘বিরাট আপস’ হিসেবে।
দিমিত্রি তাঁর বইতে যতই অসন্তোষ দেখান না কেন, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ব্যাসেল দলিলে ন্যূনতম মূলধন ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও আমাদের ব্যাংকগুলোর জন্য এই হার নির্দিষ্ট করা হয়েছে ১০ শতাংশ, পুঁজি সংরক্ষণ বাফারসহ ২০১৯ সালে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে। ব্যাসেল কমিটির কাছে আমরা অন্যান্য দেশের মতো মূলধন সংরক্ষণে ছাড় দেওয়ার জন্য ধরনা দিইনি। দিমিত্রির অসন্তোষ কিংবা উদ্বেগ আমাদের ব্যাংকিংয়ের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে আমাদের আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা উচিত নয়। অযাচিতভাবে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির বদৌলতে আমাদের কতিপয় ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য কিংবা কিছু করপোরেট ঋণগ্রহীতার ঋণমান আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও দেনদরবারকারী উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের ব্যাংকিংয়ের অবস্থা খুব বেশি দৃঢ় নয়। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো সব কূল রক্ষা করে মূলধন সংরক্ষণের এমন কঠিন শর্ত আদৌ পালন করতে পারবে কি না, এই সত্য মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে, যাতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব পুঁজি দিয়েই যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com