ব্যাংকিং খাতে ‘সুশাসন’ নিয়ে কথা কম হয়নি। কিন্তু যাঁদের এ ক্ষেত্রে তৎপর হওয়ার কথা, তাঁরা কোনো সমালোচনা গায়ে মেখেছেন বলে প্রমাণ মেলে না। ফারমার্স ব্যাংকের সংকট নিয়েও সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্টতই মাথা ঘামাতে চায়নি। কিন্তু বাগড়া দিয়েছে সংবাদমাধ্যম। রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স পাওয়া উদ্যোক্তা পরিচালকেরা মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ব্যাংকটিকে পথে বসানোর ব্যবস্থা করেছেন। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে অক্ষম ব্যাংকটি তার কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত, জরিমানা এবং পরিদর্শন রিপোর্টের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকটির সংকট ঘনীভূত হওয়ার খবর যখন দু-একটি সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হচ্ছিল তখনো সরকার অনেকটা ভাবলেশহীন থাকল। রাজনীতিক মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বাধীন ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকা খরচ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করল সংকটের কথা নিছকই অপপ্রচার। কিন্তু প্রায় একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি পাওয়ার আগেই তারা বন্ড ছেড়ে পাঁচ শ কোটি টাকা তোলার উদ্যোগ নিল। তাতেও সরকারের কারও টনক নড়ল না।
ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে যখন কোরামিন প্রয়োগ ছাড়া আর উপায় নেই, তখন সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। এখন অর্থমন্ত্রীও টের পেয়েছেন যে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকেরা লুটপাট করে প্রতিষ্ঠানটিকে শেষ করে দিয়েছেন। ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘যাঁরা এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই উদ্যোক্তা পরিচালকেরাই লুটপাট করে ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের পতন হয় না। হতে দেওয়া হয় না। (ফারমার্স ব্যাংক বন্ধের শঙ্কা নেই: অর্থমন্ত্রী, প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭)।
ব্যাংকিং খাতের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য হয়তো অর্থমন্ত্রীকেই এককভাবে দায়ী করা যেত, যদি না দেশে আদর্শ গণতন্ত্রের চর্চা থাকত। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বর্তমান দুর্দশায় সেটা যথাযথ হবে না। কেননা, তিনি জাতীয় সংসদেই তাঁর অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে রেখেছেন, যা সংসদের কার্যবিবরণী খুঁজলে পাওয়া যাবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে শুধু বেসিক ব্যাংকের কথাই স্মরণ করা যায়। বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কাগজে-কলমে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন যে রাজনৈতিক কারণেই কিছু করা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রীর পদে তাঁর দীর্ঘতম ইনিংস চালিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি বেসরকারি খাতে যে রেকর্ডসংখ্যক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছেন, সে বিষয়েও তাঁর একটি সরল স্বীকারোক্তি আছে। এসব ব্যাংক যে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত হয়েছি তাঁর কথাতেই। ব্যাংকিং খাতের এই সংকটের রাজনৈতিক দিকটিকে তাই কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ১৯৯১ সালে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন তৈরি করেছিলেন যিনি, সেই মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের দুই মেয়াদেও ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ ছিল। বিএনপির নেতা মোরশেদ খান কিংবা সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। একই ধারাবাহিকতা মরহুম অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও বজায় ছিল। কিন্তু এখন তা সর্বকালের নতুন রেকর্ড গড়েছে।
সীমান্ত ব্যাংক কিংবা প্রস্তাবিত পুলিশ ব্যাংকের পেছনে রাজনৈতিক বিবেচনা আছে িক না, সেই বিতর্কে না গিয়ে ফারমার্স ব্যাংকের রাজনৈতিক উপাদানগুলোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। এই ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা সাবেক আমলা আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন, বর্তমানে উপদেষ্টা। একসময় তিনি অর্থসচিবও ছিলেন এবং সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনে সংহতি জানাতে জনতার মঞ্চে অংশ নিয়ে বিপুলভাবে আলোচিত হন। ব্যাংকটির অনুমোদন-প্রক্রিয়ার সময় তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমানে তিনি সংসদের সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বর্তমানে পরিচালক না থাকলেও উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম (নাজমুলও ব্যাংক উদ্যোক্তা, বণিক বার্তা, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭)। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন যে তাঁর বন্ধু মেহেদি হাসান তাঁর নামে এক কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন। মেহেদি হাসানও ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা পরিচালক। পত্রিকাটির খবর অনুযায়ী, ব্যাংকটির বর্তমান নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আজমত রহমান বলেছেন যে মেহেদি হাসানকে তাঁরা নাজমুল আলমের ভাই বলেই জানেন।
কেউ রাজনীতি করলে বা কারও পরিবারের সদস্য মন্ত্রিসভার সদস্য হলে তিনি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না-এমন কোনো কথা নেই। দেশে বিদ্যমান আইনে তাঁরা এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের অধিকার থেকে বারিতও নন। সুতরাং, তাঁরা ব্যাংকের পরিচালক হতেই পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ছাত্রলীগের একজন নেতার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ও সম্পদের জোগান কোত্থেকে আসছে, সেই প্রশ্ন ব্যাংকটির অনুমোদনের সময় যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছিল কি না। আইনে কিন্তু ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষেরও ভুল হতে পারে। কিন্তু সময়মতো সেই ভুল সংশোধনের চেষ্টা হয়েছিল কি? এসব প্রশ্নের জবাব না পেলে দুর্দশাগ্রস্ত আরও দু-একটি ব্যাংককেও বাঁচানোর দায় সরকারের ঘাড়ে পড়বে না, সে কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না।
অর্থমন্ত্রী নিজেই যখন বলেছেন যে নতুন ব্যাংকগুলোর অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে, সেখানে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক যে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ব্যাংকমালিক হওয়ার সামর্থ্য ও যোগ্যতা যাচাইয়ে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল-এমনটি মনে করা কঠিন। ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রমে অনিয়ম এবং সমস্যার আলামত দেখার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বলেও জানা যায়। কিন্তু সরকারি হিসাববিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান তখন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং কার্যক্রম তদন্তের উদ্যোগ নেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী সাংসদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে, এমন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর যুক্ত থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে আসলে স্বার্থের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের ধারণা অনেক দিন ধরেই অচল।
দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং আইনে বেনামে শেয়ার ধারণের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্যে জানা যায় যে তিনি বেনামে শেয়ার ধারণে অন্য একজন পরিচালককে সহায়তা করেছেন। ব্যাংকিং আইনে এটি রীতিমতো অপরাধ। এসব বেনামি শেয়ারের বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রয়েছে বলে আইনি ভাষ্যে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই ক্ষমতা প্রয়োগের মনোবল তাদের আছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ব্যাংকটির সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন প্রশাসক নিয়োগ করে ব্যাংকটিতে আপৎকালীন নানা রকম ব্যবস্থা নিতে পারে। অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে সংকটগ্রস্ত ব্যাংককে রক্ষা করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে এবং ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হবে না। বিপন্ন ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন, বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু অর্থের সংস্থান বা পুনর্গঠনের মতো পদক্ষেপ অতীতেও দেখা গেছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব থাকলেও কখনোই কোনো ব্যাংক বিলুপ্ত হয়নি। সে রকম হলে অনেক আগেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দু-একটির অস্তিত্ব থাকত না। বণিক বার্তা এ বছরের ২ জুন এক হিসাব তুলে ধরে জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।
এরপরও চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭০১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংক (রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য আবারও ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ)। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই সংকটের কারণও রাজনৈতিক। এসব ব্যাংকেও বছরের পর বছর পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং তাঁরা ঋণও দিয়েছেন রাজনৈতিক তদবির ও প্রভাবে।
ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকেরাও জানতেন যে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের পতন হয় না এবং শেষ পর্যন্ত সংকট উদ্ধারে সরকার পদক্ষেপ নেবে। সরকারি সহায়তায় সংকট উতরে গেলে তাঁদের শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। সেই আশায় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের পরও শেয়ারের পরিমাণ বাড়ানোর আবেদনের খবর প্রকাশিত হয়। ঋণ নিয়ে অনিয়ম-অন্যায়ের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কেউ কেউ মামলার মুখে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, নয়তো জেলে আছেন। ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে আইন একই ধারায় চলবে কি? ব্যাংক রক্ষার মানে কি লুটেরারও সুরক্ষা?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।