ব্যাংকের টাকাপয়সার ‘নয়ছয়’ হয়ে গেছে, কিন্তু সুদ হারের ‘নয়-ছয়’ আর হলো না। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য পুরো ব্যাংক খাতের যে নয়ছয় হয়ে গেছে, তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে না। কিন্তু সুদহারের নয়-ছয় নিয়ে খানিকটা চিন্তিত। যদিও সুদহার আর এখন কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ বা নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নেই। আবার এ-ও ঠিক, সুদহার যে নয় আর ছয় শতাংশ হবে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভূমিকাও ছিল না। বরং নিয়ন্ত্রককে পাশ কাটিয়েই তা ঠিক করা হয়েছিল।
তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমানো নিয়ে দেশের সবগুলো ব্যাংককে ৮ জুলাই একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কর্তৃক ঘোষিত ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ৩ মাস বা তদূর্ধ্ব ৬ মাসের কম মেয়াদি আমানতের সুদ বা মুনাফার হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বাস্তবায়নের বিষয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এনইসি সম্মেলনকক্ষে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় ঐকমত্য পোষণ করা হয়।’ গত ৪ ডিসেম্বর আরেকটি চিঠি দিয়ে বিএবির ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই চিঠির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবারের চিঠিতে বলেছে, ‘জুন মাসের সুদ ও মুনাফা হার বিবরণী পর্যালোচনায় লক্ষ করা যায় যে ব্যাংকের ঋণ বা বিনিয়োগ এবং ৩ মাস থেকে ৬ মাসের কম মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদ বা মুনাফার হার যথাক্রমে ৯ শতাংশ এবং ৬ শতাংশের বেশি নির্ধারিত রয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ অবস্থায় বিএবির ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ বা বিনিয়োগ এবং আমানতের সুদ বা মুনাফার হার হ্রাস করার জন্য পুনরায় পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে।’
একান্তই রুটিন একটি চিঠি। কেননা, ঋণ ও আমানতের সুদহার কত হবে, তা এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয় না। এই কাজটি অনেক আগেই বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আর্থিক খাতের সংস্কার শুরু হয়েছিল এরশাদ সরকারের পতনের পরে, ১৯৯১ সাল থেকে। বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তার এই প্রকল্পের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল একটি বাজারভিত্তিক সুদ নীতির প্রবর্তন। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের একটি পরিসীমা বা ব্যান্ড ঠিক করে দিত, আর সুদহার এর মধ্যেই ওঠা-নামা করত। একপর্যায়ে এই দায়িত্বও ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর তখন থেকে ব্যাংকগুলো তার চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে সুদহার ঠিক করে আসছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব কেবল পরামর্শ দেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এভাবে চিঠি দেওয়া আসলে ঠিক কাজ হয়নি। বর্তমানে আর্থিক খাতের যে দুরবস্থা, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের চিঠি কোনো ব্যাংকই হয়তো আমলে নেবে না। চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে পুরো আর্থিক খাতজুড়ে। তীব্র তারল্যসংকটের কোনো সমাধান হয়নি। খেলাপি ঋণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আস্থার সংকটে নতুন আমানত আসছে না। আর ব্যাংকের বিনিয়োগ ক্ষমতা কমে গেছে বলে এর প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। অনেকেই মনে করেন, এমনিতেই নানা সংকটে ছিল দেশের ব্যাংক খাত। এর মধ্যেই আবার বাইরে থেকে নয় আর ছয় শতাংশ সুদহার চাপিয়ে দেওয়ায় ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে।
অনেক ব্যাংক এখন হন্যে হয়ে আমানত খুঁজছে। ১৪ শতাংশ সুদহারে আমানত সংগ্রহ করছে এমন উদাহরণও আছে। এতে তাদের ঋণের সুদহার ১৭-১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে। একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলছেন, সুদের হার নয় ও ছয় শতাংশে নির্ধারণ করা নয়, বরং ব্যাংক খাতের নয়ছয় নিয়েই তাঁরা বেশি চিন্তিত। কেননা বেশ কয়েকটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান তীব্র নগদ টাকার অভাবে আছে। অসংখ্য গ্রাহক আমানত রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ দেখে মনে হচ্ছে না এসব বিষয় নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা আছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি চিঠি দিতেই হয়, তাহলে দেওয়া উচিত ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বিএবিকে। নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্ত কেন তারা বাস্তবায়ন করতে পারছে না, সেই কৈফিয়ত তো দিতে হবে বিএবিকেই।
মনে করিয়ে রাখি, গত বছরের ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বিএবি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করে ঋণ ও আমানতের সুদহার নয় ও ছয় শতাংশে নির্ধারণ করেছিল। এর বিনিময়ে তারা করপোরেট আয়কর কমানোসহ সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়। কিন্তু সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছেন। কথা বলেছেন মন্ত্রীরা।
কিন্তু এ নিয়ে এখন আর কেউ প্রশ্নও তুলছেন না। কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক রুটিন একটি চিঠি দিয়ে চুপচাপ দর্শকের ভূমিকায় আবার গ্যালারিতে বসে গেছে। ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, ভুল নীতি, নজরদারির দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের আস্থার অভাব-কোনো কিছুতেই যেন তাদের কিছু যায় আসে না।
এটা ঠিক যে সুদহারের নয়-ছয় করার দায়িত্ব আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের না। কিন্তু সাধারণ মানুষের রাখা আমানতের অর্থ নয়ছয় বন্ধ করার দায়িত্ব তাদের। ব্যাংকের মোট মূলধনের ৯০ শতাংশের জোগানদাতাই আমানতকারীরা। এ অবস্থায় কেবল রুটিন চিঠি না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা রাখুক। ব্যাংক একটি দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালক। আর আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি ব্যাংকনির্ভর। সুতরাং এই খাতের সংকট পুরো অর্থনীতিকেই বিপাকে ফেলে দেবে।
দেউলিয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ ২০১৫ সালেই জানা ছিল প্রতিষ্ঠানটির দুর্গতির কথা। তখন কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এখন হয়তো অবসায়ন এড়ানো যেত। পিপলস লিজিং একটি উদাহরণমাত্র। পুরো দায় এখন বাংলাদেশ ব্যাংককেই নিতে হবে। এ রকম আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশে আরও আছে। সুতরাং পরে দায় না নিয়ে আগেই দায়িত্ব নিক বাংলাদেশ ব্যাংক।
একটা ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই একধরনের অনিশ্চয়তার আভাস আছে। কেননা, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কবে আলোচনা হবে, আর তার ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত কবে কমিশন গঠন করা হবে, তা একেবারেই নিশ্চিত নয়। এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।
তবে ব্যাংক কমিশন গঠন হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কমিশনের কার্যপ্রণালি বিধি বা টার্মস অব রেফারেন্স কী হবে, সেটা সরকারই ঠিক করে দেবে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের প্রকৃত সমস্যা ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা অঙ্গীকার না থাকলে কমিশন গঠন করেও কোনো লাভ হবে না।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ব্যাংকের নয়ছয় করা নিয়ে। শেষ করি এ নিয়ে ছোট্ট একটা কৌতুক বলে। একটা মানুষকে যদি বন্দুক দেওয়া হয়, তাহলে সে বড়জোর একটা ব্যাংক ডাকাতি করতে পারবে। কিন্তু একটা মানুষকে ব্যাংকটাই দিয়ে দিলে সে পুরো দুনিয়াই ডাকাতি করতে থাকবে।
এ রকম কিছু মানুষের হাতেই এখন আমাদের ব্যাংক খাত।
শওকত হোসেন বিশেষ বার্তা সম্পাদক
shawkat. massum@prothomalo. com