দুনিয়ার কোন দেশের নির্বাচনে কারা বিজয়ী হলেন আর কারা পরাজিত, তা আমাদের জন্য একটা খবর বটে, তার বেশি কিছু নয়। যার যার নিজের দেশের চরকায় তেল দেওয়া ভালো। কিন্তু ১২ ডিসেম্বরের যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে আমাদের পত্রপত্রিকা উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেছে। কোনো পত্রিকা লিখেছে নির্বাচনের ফলাফলে ‘ব্রিটেন ও বাংলাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে’ গেছে।
বোকার আনন্দ প্রকাশ আর বুদ্ধিমানের আনন্দ প্রকাশ দুই রকম। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল বাংলাদেশিদের জন্য আনন্দের বটে, তবে তা ভেবে দেখার বিষয়। বাঙালিদের জন্য তা নিছক খবরের চেয়ে কিছু বেশি: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চার প্রার্থীর জয় এবং তাঁরা সবাই নারী।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া ইস্যুতে এই মধ্যবর্তী নির্বাচনটি হয়েছে। যুক্তরাজ্যে সাধারণত পাঁচ বছর পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইস্যুতে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনবার সাধারণ নির্বাচন হলো। এর আগে ২০১৫-এর মে এবং ২০১৭-এর জুনে নির্বাচন হয়। ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬৫টি পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, দ্বিতীয় স্থানে লেবার পার্টি পেয়েছে ২০৩টি আসন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা সবাই লেবার পার্টির।
বাঙালি নারী প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে গেছেন রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক ও আফসানা বেগম। রুশনারা এ নিয়ে চারবার এমপি হলেন। তিনি পেয়েছেন ৪৪ হাজার ৫২ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৫২৮ ভোট। টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮০ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ১৩ হাজার ৮৯২ ভোট। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার কন্যা। তিনি পরপর দুবার এমপি হলেন। রূপা হক পেয়েছেন ২৮ হাজার ১৩২ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ১৪ হাজার ৮৩২ ভোট। তিনিও পুনর্নির্বাচিত হলেন। এবার নতুন আফসানা বেগম। তিনি পেয়েছেন ৩৮ হাজার ৬৬০ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র ৯ হাজার ৭৫৬ ভোট। তাঁদের অভিনন্দন।
যাঁরা ব্রিটেনে এমপি হয়েছেন, তাঁরা কেউই পারিবারিক পরিচয়ে পরিচিত নন। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী একটি দেশে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় প্রাধান্য পায়নি। তাঁরা নারী না পুরুষ, সে প্রশ্ন কেউ তোলেনি। তাঁরা শ্বেতাঙ্গ না অশ্বেতাঙ্গ, সেটা বিবেচ্য ছিল না। তাঁরা ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত না অন্য কোনো দেশ থেকে এসেছেন, ভোটাররা তা নিয়ে মাথা ঘামাননি।
ব্রিটেন সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার। সংসদীয় গণতন্ত্র দলীয় বা বহুদলীয় গণতন্ত্র। বাঙালি-ব্রিটিশ যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সে দেশের প্রধান প্রগতিশীল দলের সদস্য, কোনো রক্ষণশীল দলের নন। তাঁরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় কতটা জনপ্রিয় তা প্রাপ্ত ভোট থেকেই বোঝা যায়। বিজয়িনীরা সবাই সুশিক্ষিত, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, জনগণের মধ্যে কাজ করে তাঁরা মানুষের মন জয় করেছেন। মোটকথা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণেই তাঁদের এই অবস্থান। বাংলাদেশি টাইপ গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনীব্যবস্থা যুক্তরাজ্যে থাকলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে কারও জামানত বাজেয়াপ্ত হতো।
বিজয়িনী চারজনই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, আমাদের দেশের মতো ‘সংরক্ষিত আসন’ থেকে নয়। কোটা থেকে কোনো কিছু প্রাপ্তিতে গৌরব নেই, তবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য সাময়িকভাবে কোটা রাখা প্রয়োজন। সেই বিবেচনা থেকেই ১৯৭২-এ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় তাতে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে ১০ বছরকাল অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাঙ্গিয়া না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে।’ তখন এই সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত ছিল।
উল্লিখিত ১০ বছর শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৮২-তে, এর মধ্যে আসে সামরিক শাসন। সামরিক সরকার জনগণের সরকার না হওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীকে খুশি করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকার এক ফরমান জারি করে সংরক্ষিত আসনের সময়কাল ১০ থেকে বাড়িয়ে করে ১৫ বছর এবং আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করে ৩০। সে হিসাবে ১৯৮৭-এর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ নারী আসন সংরক্ষিত থাকার কথা।
১৯৭২-এ বাংলাদেশে নারীরা জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। আশির দশক নাগাদ অবস্থার উন্নতি হবে এই প্রত্যাশা থেকে সংরক্ষিত আসনের সময়সীমা ১০ বছর করা হয়েছিল। বাস্তবিক পক্ষেই স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৫ বছরে বাংলাদেশে নারীর অভাবিত অগ্রগতি হয়েছে। আশির দশক থেকে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই মহিলা।
তৃতীয় সংসদ থেকে বাংলাদেশে নারীদের কেউ কেউ সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমপি হয়েছেন। কিন্তু দু-একজন ছাড়া তাঁরা কারা? তাঁরা হয় কোনো পুরুষ এমপির বিধবা স্ত্রী অথবা মেয়ে। এই প্রবণতা অত্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক এবং ঘোরতর অগণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি উত্তরাধিকারী বলেও কিছু নেই। কোনো উপাচার্য মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বা মেয়েকে ওই পদে নিযুক্তি দেওয়ার বিধান নেই। কোনো সচিব মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বা মেয়েকে শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে বলেই তাঁর পদে নিয়োগ দেয় না রাষ্ট্র। কিন্তু একজন সাংসদ মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বা মেয়েকে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে তাঁর আসনে ‘যেকোনো উপায়ে’ জিতিয়ে আনা অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক কাজ। ফলে ওই এলাকায় নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ কাঁটা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই কাঁটা সরানোর সাধ্য সেখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কোনো রাজনীতিকের পক্ষেও সম্ভব নয়।
যদি কেউ বলেন, ব্রিটেনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা তা হয়েছেন তাঁদের যোগ্যতার জন্য অথবা দলের কারণে। সেটা আংশিক সত্য। তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একটি দিকমাত্র। তাঁদের চেয়ে শিক্ষিত ওই এলাকায় আর কোনো নেতা নেই, তা হয়তো নয়। তাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে তাঁদের মতো শিক্ষিত নারী রাজনীতিক নেই, তা নয়। সব বড় দলেই তেমন কেউ আছেন। কিন্তু বঙ্গীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় তাঁদের পক্ষে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
ক্রমাগত বাংলাদেশে নারী সংরক্ষিত আসনসংখ্যা এবং তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তা বাড়ানোর দাবিও কেউ করেনি প্রেসক্লাবে গোলটেবিল বা রাস্তার মানববন্ধন থেকে। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) আইন, ২০১৮’ করে সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে করেছে ৫০ এবং মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরও ২৫ বছর। অর্থাৎ ২০৪৪ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা থাকবে, যদি আরও বাড়ানো না হয়।
এই ব্যবস্থা বলে দেয় জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন নারীর অনগ্রসরতার মাত্রা আরও বেড়েছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় মেয়েরা আজ অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাঁরা ভালো করছেন। ইউএনও, ডিসি, এসপির দায়িত্ব তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন। সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের নারীরা দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হচ্ছেন। বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজে তাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাষ্ট্রদূত, উপাচার্য হচ্ছেন। সেই সময় তাঁদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য এটা ক্ষতিকর। মাঝারি উন্নত দেশের পক্ষে এটা বেমানান। তবে এখনো সংরক্ষিত আসন থাকবে, তা অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণি ও জনগোষ্ঠীর জন্য।
দেড় শ বছর ধরে অব্যাহতভাবে বলা হচ্ছে জনগণের সরকার, জনগণের জন্য সরকার এবং জনগণের কর্তৃত্বের সরকার—এই তিনের সমন্বয়ে গণতন্ত্র। তবে ‘জনগণের কর্তৃত্বের সরকার’ না হলে যত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হোক, তা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার নয়। গোষ্ঠীস্বার্থে গণতন্ত্রকে সব দিক থেকে আক্রমণ করা একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতি না ঘটালে উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্ন পূরণ হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক