ডা. জেইনের চোখ ভিজে আসছে। ১ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখলেন, আপনার কী মনে হলো?’
শূন্য দৃষ্টি মেলে ধরে প্রবীণ যক্ষ্মা চিকিৎসক কথা হাতড়ান। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘অবর্ণনীয়। অমানবিক। মানবতাবিরোধী। আমরা কল্পনাও করতে পারি না, এত বিশাল এত বিশাল। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মানবেতর জীবনকেই শ্রেয় মনে করছে, তাহলে মিয়ানমারে কত ভয়াবহ নৃশংসতা ঘটেছে যে এরা রোজ হাজারে হাজারে আসছে? এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশছাড়া হয়ে কখনো অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে কি?’
জেইন কার্টার আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ। পৃথিবীকে যক্ষ্মামুক্ত করার আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা। বাংলাদেশেও এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গবেষক ডা. রুহুল আবিদ। তাঁর একটা সংগঠন আছে। হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল। রোহিঙ্গারা যখন আসতে লাগল লাখে লাখে, জেইন কিংবা ডা. রুহুলরা বিচলিত হলেন। কাজ শুরু করে দিলেন আশ্রয় শিবিরে। কুতুপালং আর বালুখালী দুই শিবিরে সরকারি মেডিকেল ক্যাম্পের অর্ধেকটাজুড়ে তাঁরাও সেবাকেন্দ্র খুলেছেন। সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন। রোজ কয়েক শ রোহিঙ্গা রোগী আসে তাঁদের কেন্দ্রে। তাঁরা রোহিঙ্গাদের নাম, ছবি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যতথ্য কম্পিউটারে নিয়ে রাখেন। তাঁরা রোগীদের একটা মেশিন রিডেবল কার্ড দেন। দেন ব্যবস্থাপত্র আর ওষুধ।
আমেরিকায় বসে তাঁরা খবরাখবর রাখেন। তহবিল সংগ্রহ করেন। জনমত সংগঠিত করেন। সশরীরে এসে রোহিঙ্গাদের শিবিরে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ আগস্টের ২৫ তারিখের পরে দুই মাসে এসে পড়েছে মিয়ানমার থেকে। অর্ধেকই শিশু। তারা থাকবে কোথায়, খাবে কী, টয়লেট করবে কোথায়, পানি পাবে কোথায়?
গত ৩১ অক্টোবর আমিও চললাম তাঁদের সঙ্গে। প্রথমে কুতুপালং শিবিরে। কাদাময় মাটির রাস্তার দুই ধারে, পাহাড়ে, পাহাড়ের ঢালে, উপত্যকায়, সমভূমিতে সারি সারি বস্তিঘর। সদ্য বানানো। বাঁশের খুঁটি। ওপরে পলিথিন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের ঘর বানানোর এসব উপকরণ দেওয়া হয়েছে, তারা নিজেরাই ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। যে পরিবারে ঘর বানানোর মতো সামর্থ্যবান লোক নেই, তাদের ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশছাড়া হয়ে আমরা সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করেছি এই আশায় যে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পাব, দেশ স্বাধীন হলে আমরা ঘরে ফিরে যাব। কিন্তু মিয়ানমারের এই নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সামনে সে আশা নেই। ১৯৮২ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই। তারা নিজ দেশে চলাচল করতে পারে না। আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হয় না। তাদের কোনো স্বাস্থ্যসুবিধা নেই, শিক্ষার অধিকার নেই। প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশরা যখন মিয়ানমারকে উপনিবেশ বানিয়েছিল, তার পরে যারা বার্মায় গিয়েছে, তাদের তারা অস্বীকার করে। কিন্তু তাহলেও তারা ইতিহাসের এই সত্য মেনে নেয় না যে মিয়ানমারের আরাকানে এই জনগোষ্ঠী আছে শত শত বছর ধরে, কেউবা হাজার বছর ধরে।
কুতুপালং শিবিরে ছাউনিগুলোয় ঘুরি। স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসানো হয়েছিল। অনেকগুলোই ভরে উঠেছে। উপচে ময়লা তরল ভেসে যাচ্ছে ড্রেন দিয়ে। একটা ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ছাউনিতে ১০-১২ জন নারী–শিশু–পুরুষ গাদাগাদি করে থাকে। খাদ্যের অভাব নেই। বাংলাদেশের মানুষ সারা দেশ থেকে ত্রাণসাহায্য নিয়ে ছুটে গিয়েছেন। জেলা প্রশাসক বলেন, দেশের মানুষের সাহায্যই সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খাওয়াবে বলে কাজ শুরু করেছে। সরকারি প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, আরআরআরসি মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে। খাবার যা আসে, তা এক জায়গায় জমা নেওয়া হয়। সেখান থেকে শিবিরে শিবিরে বিতরণ করা হয়। ১৫ দিনে একবার করে পরিবারপ্রতি ২৫ কেজি চাল দেওয়া হয়। ডাল-নুন-তেল দেওয়া হয়।
বিশাল লাইন। বাঁশ দিয়ে ঘেরা ছাউনির নিচের পরিসরে মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে কার্ড। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। কর্মীরা খাবারের প্যাকেট গাড়ি থেকে নেমে তুলে দিচ্ছেন মানুষের হাতে হাতে। একজন জওয়ান বললেন, এরা বলে, খাদ্যের অভাব নাই, এখন অভাব রান্নার জ্বালানির।
চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতেও নারী-শিশু-বৃদ্ধের ভিড়। এরই মধ্যে মায়ের কোলে এসেছে এক শিশু। তার বয়স মাত্র ১৪ দিন। ডা. জেইন তাকে দেখে কেঁদে ফেললেন। বোধ হয় শিশুটা মারা গেছে। ডা. রুহুল এগিয়ে গেলেন। না, মারা যায়নি। এই শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। হাসপাতাল কত দূরে? কীভাবে নেবে তাকে হাসপাতালে? কে নেবে?
বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে হবে, কারণ এবার যে প্রায় ৬–৭ লাখ মানুষ এসেছে মাত্র দুই মাসে, আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে, এখনো রোজ আসছে, হাজারে হাজারে, এদের কেউই না খেয়ে মারা যায়নি। এদের সবাইকে কলেরার
টিকা দেওয়া হয়েছে। এদের সবাই মাথা গোঁজার একটা ন্যূনতম ব্যবস্থা পাচ্ছে।
চিকিৎসাকেন্দ্রে একটা বালক এসেছে। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। ডাক্তাররা বললেন, এমন পরিবার পাওয়া যায় না, যারা কোনো না কোনো ক্ষতির শিকার। প্রতিটা নারী হয় নিজে অত্যাচারিত হয়েছেন, না হলে কাউকে অত্যাচারিত হতে দেখেছেন।
‘আপনার পরিবারে কজন আছেন?’
‘সাতজন ছিলাম। পাঁচজন এসেছি।’
‘আর দুজন?’
‘আমার ছেলে দুজনকে আমার সামনে মেরে ফেলেছে।’
এখানে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরা এই রকমের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি প্রায়ই হন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ট্রমা কেন্দ্রের সাইনবোর্ড দেখলাম।
প্রচণ্ড আঘাতে মানুষগুলো নির্বাক হয়ে গেছে। যারা এখানে আসে, তাদের চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। শূন্যতা শুধু শূন্যতা। তাদের বাড়িঘর ছিল, জমিজিরেত ছিল, জন্মভূমি ছিল, স্মৃতি ছিল—সব ছেড়েছুড়ে জীবন আর ইজ্জত বাঁচাতে তারা চলে এসেছে। তারা জানে না, তাদের ভবিষ্যৎ কী।
একটা পলিথিনে ঢাকা চালার নিচে ১০-১২ জন। রান্নাঘর নেই, গোসলখানা নেই। তবু তাদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়, আগে ভালো ছিলেন, নাকি এখানে ভালো আছেন? তারা বলে, এখানে ভালো আছি।
এটা তাঁরা বলেন, কারণ এখানে কেউ গুলি চালাবে না, আগুন দেবে না, ধর্ষণ করবে না।
দুই পাশে পাহাড় কেটে কেটে ধাপে ধাপে ছাউনি বানানো হয়েছে। আড়াই হাজার একর জমিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
বিদেশিরা আসছে প্রচুর। জাতিসংঘের প্রায় ছয় শ কর্মী কাজ করছেন, শুনতে পেলাম জাতিসংঘের একজন কর্মীর কাছে। ইউএন লেখা বড় বড় গাড়ি চলাফেরা করছে। হোটেলগুলোতে রুম পাওয়া ভার। জাতিসংঘের একজন কর্মী জানালেন, তাঁরা কাজ করছেন স্থানীয় লোকদের ওপরে রোহিঙ্গা-আগমনের প্রতিক্রিয়া জরিপ করতে। বনভূমি, পাহাড় নষ্ট হচ্ছে, কাজের সুযোগ বাড়ছে, আবার কোথাও কমছে। স্থানীয় লোকজন দেখছে গাড়ি গাড়ি সাহায্য আসছে, তা যাচ্ছে বহিরাগতদের কাছে। তাদের মনে প্রতিক্রিয়াটা কী হচ্ছে?
এনজিওগুলো কাজ করছে। ব্র্যাকের মতো বড় এনজিও, স্থানীয় এনজিও।
জাতিসংঘের আরেকটা দল কাজ করছে রোহিঙ্গাদের ওপরে মিয়ানমারের নিপীড়নের মাত্রা আর বহর নিরূপণ করার জন্য। তারা বলছে, তারা শুধু বাংলাদেশে নয়, মিয়ানমারের ভেতরেও এই কাজ করার চেষ্টা করছে। আর শুধু রাখাইন অঞ্চলে নয়, এর বাইরেও কোথায় কেমন মানবতাবিরোধী কাজ করা হয়েছে, তারা তা রিপোর্ট করবে।
আমি কাঁচা রাস্তা ধরে শিবিরের মধ্য দিয়ে হাঁটি। শিশুদের সঙ্গে গল্প করি। কারও নাম মোস্তফা, কারও নাম হাসান। কারও নাম আনোয়ারা, কারও নাম খাদেজা। কেউ কোনো দিন স্কুলে যায়নি। মেয়েদের প্রায় প্রত্যেকের কানে অতি সস্তা উজ্জ্বল দুল। ছেলেদের হাতে প্লাস্টিকের খেলনা। বাংলাদেশিরা এর মধ্যেই ভাতের দোকান বা মনিহারি দোকান দিয়েছে। ছোট ছোট চাটাই পেতে রোহিঙ্গারাও দোকান খুলেছে। সস্তা চকলেট বা খেলনা পাওয়া যায়।
রঙিন ললিপপ মুখে একটা শিশু। কতগুলো শিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভাবলেশহীন চেহারা। তারা স্কুলে যাবে না? তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই?
কজন হাইস্কুল পাস যুবক এলেন ডাক্তার রুহুলের কাছে। ‘স্যার, একটা স্কুল খুলে দেন, আমরা পড়াই।’
বাংলাদেশ চাইছে এদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে। বাইরে থেকে, খোলা চোখে আমরা বুঝছি, ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমার মানবতা-দলনের কাজটা করেনি। এটা তাদের বহুদিনের পরিকল্পনার অংশ। রোহিঙ্গাদের তারা বিতাড়িত করবে। রোহিঙ্গামুক্ত মিয়ানমার গড়বে। বাংলাদেশ এদের শরণার্থীও বলছে না। বলছে, বলপূর্বক স্থানান্তরিত মিয়ানমার নাগরিক।
জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ দুর্বল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ এত বিপুল মানুষের ভার সইতে পারবে না। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হবে, স্থানীয় লোকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবে, দেশি-বিদেশি অপরাধী চক্র সক্রিয় হবে। আবার নিষ্ঠুরের মতো এদের বলপূর্বক ঠেলে ফেরত পাঠানোর মতো অমানবিক কাজও আমরা করতে পারব না।
তাহলে উপায় কী রইল? একটাই উপায়, এথনিক ক্লিনজিংয়ের জন্য মিয়ানমারের জান্তার বিচার দাবি করা। প্রবল বিশ্বজনমত গড়ে তোলা আর মিয়ানমারকে বাধ্য করা, যাতে তাদের নাগরিকদের উপযুক্ত সম্মান, মর্যাদা, অধিকার আর নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে ফিরিয়ে নেয়।
একটা ভালো ফটোগ্রাফও অনেক সময় বিশ্ববিবেক নাড়িয়ে দেয়। একটা ভালো ভিডিও ক্লিপ অনেক সময় লক্ষ মানুষের জমায়েতের চেয়ে বড় কাজ করে।
আর মিলিয়ন ম্যান মার্চ ধরনের কর্মসূচির কথা তো ভাবা যেতেই পারে। বিশ্ববিবেক বলতে অধুনালুপ্ত জিনিসটাকে যেভাবেই হোক জাগিয়ে তুলতে হবে।
আমরা ঢাকায় ফিরে আসি, রোহিঙ্গা শিশুদের ব্যথাভরা চোখের চাহনি আমাদের তাড়িয়ে ফেরে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।