১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ ছিল জাপানি ভূখণ্ডে মার্কিন সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় আণবিক বোমা হামলা। শহরের ওপর বিস্ফোরিত সেই বোমার শক্তি ছিল এর তিন দিন আগে হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়ে অনেক বেশি এবং আকারগত দিক থেকেও ছিল বড়। এর ফলে বোমাবর্ষণকারীরা হিরোশিমায় ফেলা বোমার নামকরণ ‘লিটল বয়’ করলেও নাগাসাকির বোমার নাম তারা দিয়েছিল ‘ফ্যাট ম্যান’ বা মোটা মানুষ। হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর আরও বেশি শক্তিশালী একটি আণবিক বোমা ধ্বংসের মাত্রাকে কতটা বিস্তৃত করতে পারে, সেটা তারা দেখতে চেয়েছিল। তবে প্রকৃতি আর আবহাওয়া পরিস্থিতি নাগাসাকির জন্য সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য—এই দুয়েরই কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
নাগাসাকির দুর্ভাগ্য এ কারণে যে বোমা হামলার প্রাথমিক লক্ষ্যস্থল জাপানের সেই শহরটি ছিল না, বরং তা ছিল নাগাসাকির আরেকটু উত্তরে অবস্থিত ফুকুওকা জেলার কোকুরা শহর, যে শহর এখন কিতা কিউশু সিটি নামে পরিচিত। তবে বোমারু বিমানের পাইলট আর ন্যাভিগেটররা কোকুরার কাছাকাছি এসে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে যাওয়ায় লক্ষ্য পাল্টে নাগাসাকির দিকে তাঁরা ধাবিত হন এবং দ্বিতীয় বাছাই সেই শহরের ওপর পৌঁছে যাওয়ার পর ফ্যাট ম্যানকে বিমানের তলার দিকের ডালা খুলে ছেড়ে দেন। ঘড়িতে তখন সময় ছিল বেলা ১১টা বেজে ২ মিনিট।
তবে আবহাওয়া একদিক থেকে নাগাসাকির জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দেখা দিলেও শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ কিন্তু ধ্বংসের মাত্রা হ্রাসে নাগাসাকিকে সাহায্য করেছিল। হিরোশিমার বিপরীতে নাগাসাকি হচ্ছে পাহাড়ঘেরা শহর। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়া এবং ধ্বংসের ব্যাপকতার বিস্তার রোধে শহরের চারদিকের পাহাড় সেদিন সহায়ক হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবে তারপরও নগরকেন্দ্রের মাৎসুইয়ামা-মাচির ৫০০ মিটার ওপরে বিস্ফোরিত ফ্যাট ম্যানের ধ্বংসলীলা কোনো অবস্থাতেই কম ছিল না। নাগাসাকির সেদিনের আণবিক বোমা হামলায় সে বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছিল ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন নগরবাসী এবং আহত হয়েছিল আরও প্রায় ৭৫ হাজার। শহরের বিশাল এক অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং পরবর্তী সময় আরও অনেকে তেজস্ক্রিয়াজনিত নানা রকম অসুখে ভুগে প্রাণ হারায়।
জাপানের নাগাসাকি শহর এখন হিরোশিমার পাশাপাশি আণবিক বোমার ভয়াবহতার বার্তা বিশ্বজুড়ে পৌঁছে দেওয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের ৯ তারিখে শহরে স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাড়াও সারা বছর নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে যে বার্তা নাগাসাকি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে, তা হলো, ‘নাগাসাকি যেন হয় আণবিক হামলার শিকার হওয়া বিশ্বের শেষ জনপদ।’ তবে হিরোশিমার মতোই স্মৃতি ধরে রাখার সমস্যার মুখে এ শহরকে পড়তে হচ্ছে। কারণ আণবিক বোমা হামলার অভিজ্ঞতার মুখে পড়া প্রজন্ম এখন ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাই ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার সরাসরি বর্ণনা দিয়ে মানব অনুভূতিকে সহজে জাগ্রত করার মানুষ এখন ক্রমেই কমে আসতে থাকায় স্মৃতি ধরে রাখার নতুন নানা রকম পথের সন্ধানে শহরকে থাকতে হচ্ছে। ঠিক সে রকম একটি চমৎকার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে নাগাসাকির শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুল।
নাগাসাকি শহরের শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুলের অবস্থান হচ্ছে হাইপোসেন্টার নামে পরিচিত বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার কেন্দ্রস্থল থেকে ৫০০ মিটার উত্তরে। কংক্রিটের তৈরি তিন তলা স্কুলভবনটি বিস্ফোরণে পুড়ে যায় এবং ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা ধসে পড়ে। তবে জুলাই-আগস্ট মাস জাপানে গ্রীষ্মের ছুটির সময় হওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে কেউ তখন স্কুলে ছিল না। যে ৩১ জন শিক্ষক ও কর্মচারী ভবনে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের মধ্যে ২৮ জন প্রাণ হারান। তবে ছাত্ররা সেদিন স্কুলে উপস্থিত না থাকলেও আণবিক বোমা হামলার হাত থেকে এরা কিন্তু রক্ষা পায়নি।
জাপানে সরকারি প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্র ভর্তির বেলায় যে নিয়ম অনুসরণ করা হয়, সেটা হচ্ছে বসতির জায়গাভিত্তিক। অর্থাৎ, স্কুলের কাছের নির্দিষ্ট একটি পরিসীমার মধ্যে বসবাসরত বালক-বালিকারা এলাকার নির্দিষ্ট একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে থাকে। শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুলের বেলাতেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছিল। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীদের সবাই ছিল সেই এলাকার বাসিন্দা। এলাকাটি বিস্ফোরণ কেন্দ্রের কাছাকাছি হওয়ায় এদের অনেকের বাড়িঘর সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল এবং অনেকেই হামলা থেকে বাঁচতে পারেনি। স্কুলের ছাত্রসংখ্যা সেই সময় ছিল ১৫০০। তাদের মধ্যে ১৪০০ জন আণবিক বোমা হামলায় প্রাণ হারায়।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আমি গিয়েছিলাম শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুলের স্মৃতি ধরে রাখায় নেওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার জন্য। ১০টি দেশের সাংবাদিকদের সেই গ্রুপকে সেদিন স্কুলভবনে স্বাগত জানান স্কুলের বর্তমান অধ্যক্ষ হিরোয়াকি তাকেমুরা। আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত একটি স্কুল সেটা হওয়ায় স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটতে পারে, সে জন্য তরুণ প্রজন্মের কাছে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়াকে তাকেমুরা প্রধান একটি দায়িত্ব বলে মনে করেন। আর স্কুল সেই দায়িত্ব পালন শুরু করেছে স্কুলের ভেতর থেকেই। স্মৃতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা কেবল বোমা হামলার বার্ষিকী চলে আসার দিনগুলোতেই সীমিত নেই। সারা বছর ধরেই নানা রকম কর্মকাণ্ড স্কুলের হাতে নেওয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে একবার করে স্কুলে শান্তি স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন বসে। ১৯৫৮ সালে এই নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮০০ বারের বেশি সেটা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিশুরা সেখানে আণবিক বোমা হামলার ভয়াবহতার অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাঠ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকেও তা শুনে থাকে। এ ছাড়া স্কুলের বিধ্বস্ত ভবন সম্পর্কে এরা শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে পারছে। এর বাইরে ছয়টি ক্লাসের প্রতিটির জন্য নির্ধারণ করা আছে ভিন্ন কিছু দায়িত্ব, যা পালন করার মধ্যে দিয়ে শান্তির গুরুত্বের বার্তা ছাত্ররা পায়।
প্রথম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব হলো কাইয়োকোর চেরিগাছের যত্ন নেওয়া। কাইয়োকো হায়াশি ছিল শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী এবং আণবিক বোমা হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে। কন্যার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কাইয়োকোর মা সুয়ে ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েকটি চেরি ফুলগাছের চারা স্কুলকে দিয়েছিলেন। চেরি ফুল ছিল কাইয়োকোর পছন্দের ফুল। স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলের খেলার মাঠের একদিকে কাইয়োকোর মায়ের দেওয়া চেরিগাছের চারার পাশাপাশি আরও কিছু চারা সেই সময় রোপণ করেছিল। সেই চারাগুলো এখন গাছের আকার নিয়েছে এবং প্রতিবছর বসন্তকালে চেরি ফুলের শোভায় সেই উদ্যান ভরে যায়। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দায়িত্ব হচ্ছে বাগানের প্রতিটি চেরিগাছের যত্ন নেওয়া, যে দায়িত্ব পালন করার মধ্যে দিয়ে কাইয়োকো এবং আণবিক বোমা হামলা সম্পর্কেও এদের জানা হয়ে যায়। চেরি বাগানে এ ছাড়াও আছে একটি শান্তি ভাস্কর্য আর শান্তির ঘণ্টা; কাইয়োকোর মা মারা যাওয়ার সময় স্কুলকে তাঁর যাবতীয় সম্পদ দান করে গেলে সেই অর্থে সেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা স্কুলের মূল ভবনের সামনে বসানো এক বালকের মূর্তির পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সেই মূর্তি ও এর চারদিক পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করে। আণবিক বোমা হামলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়া স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের অনুকরণে তৈরি সেই ভাস্কর্যের নকশা করেছেন ইয়োশিও তোমিনাগা। ১৯৫১ সালের ৮ আগস্ট আণবিক বোমা হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকীর প্রাক্কালে সেটা সেখানে বসিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই বালকও পরে বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেনি। ভাস্কর্যটির সামনে হস্তলিপিতে শান্তি কথাটি লেখা আছে, যে হাতের লেখা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তেজস্ক্রিয়ার শিকার হয়ে ঘটনাক্রমে বেঁচে যাওয়া তায়েকো সুগাওয়ারার।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্ররা নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলার পর আহত লোকজনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া নাগাসাকিবাসী চিকিৎসক তাকাশি নাগাই সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে এবং সেই চিকিৎসকের স্মরণে নামকরণ করা নাগাই ঢালজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেরিগাছের যত্ন নেয়। ডা. নাগাই তাঁর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে যে বই লিখেছিলেন, সেটা থেকে নিয়মিত পাঠ করাও হচ্ছে এদের দায়িত্ব।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্ররা শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রাকারের কাগজের সারস তৈরির কাজ একই সঙ্গে শুরু করে। এরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে যাওয়ার সময় এক হাজার সারস তৈরি শেষ হয়ে যায় এবং সেই সারসসহ শান্তির বার্তা স্কুলের নবাগত শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্ররা স্কুল ভবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে এবং বিধ্বস্ত ভবনের অবশিষ্ট একটি অংশে তৈরি হওয়া সংগ্রহশালার রক্ষণাবেক্ষণের এরা পালন করে।
ভাগাভাগি করে পালন করা নিয়মিত এসব দায়িত্বের বাইরে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিদেশের স্কুলের সঙ্গেও চিঠিপত্র আদান-প্রদানের যোগাযোগ তাদের আছে। আণবিক বোমা হামলায় বিধ্বস্ত নাগাসাকির সেই প্রাইমারি স্কুল নিজেদের স্কুলের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মৃতি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে, তাঁর মূলে আছে সেই বার্তা—নাগাসাকি যেন হয় আণবিক হামলার শিকার হওয়া বিশ্বের শেষ জনপদ।
আগের পর্ব দেখুন: আণবিক বোমা হামলা ও হিরোশিমার সাহসী চিকিৎসাকর্মীরা