ভবনে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং মানুষ ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজন কার্যকর ফায়ার ডিটেকশন ও প্রোটেকশন ব্যবস্থা। ভবনের মালিকেরা এ বিষয়ে আগের চেয়ে একটু সচেতন হয়েছেন। কিন্তু বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের সূত্রপাত প্রতিরোধের বিষয়ে আজও সচেতনতা ও সতর্কতার অভাব আছে। বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের সূত্রপাত প্রতিরোধে সচেতন হওয়া খুব জরুরি।
এ কথা তো কমবেশি সবাই জানি যে নকশার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ, সম্পত্তি ও পশুসম্পদের নিরাপত্তা বিধান। কিন্তু বিল্ডিং সার্ভিস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বহু ভবনমালিক ঢাকা মহানগর নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন, এমন অযোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে নকশা করান, লাইসেন্সধারী যোগ্য ঠিকাদার নিয়োগ করেন না। অথচ নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ বিদ্যুৎ পেতে বৈদ্যুতিক নকশা, মানসম্মত বৈদ্যুতিক উপকরণ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ ও যোগ্য ঠিকাদারেরাই নির্মাণকাজের মান নিশ্চিত করতে পারেন। সাধারণত বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের সূত্রপাতের জন্য দায়ী দুর্বল নকশা, ইনস্টলেশন, অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশের গুরুত্ব অনুধাবনের অযোগ্যতা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক উপকরণ, ঝড় ও বজ্রপাত।
দুর্বল নকশা
দুর্বল নকশায় কোড ও স্ট্যান্ডার্ডসের সঙ্গে অসংগতি, অপর্যাপ্ত কেব্ল সাইজ এবং অনুপযুক্ত ওভারলোড ও শর্টসার্কিট প্রোটেকশন পরিলক্ষিত হয়। ওভারলোডের কারণে ওয়্যারিংয়ে যখন অধিকতর কারেন্ট প্রবাহিত হয়, তখন অনেক বেশি তাপ উৎপন্ন হয়, যা কেবলের অন্তরণকে (ইনসুলেশন) ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আগুনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সার্কিট ব্রেকার অতি বড় হলে সার্কিটের ওভারলোড শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে সার্কিট ওভারহিট হয়ে আগুন লাগার আশঙ্কা তৈরি হয়। অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের অধিকাংশ ভবনে কেব্ল রাইজার অপর্যাপ্ত। গ্রুপ ফ্যাক্টর বিবেচনায় না নিয়ে কেব্ল গুচ্ছভাবে অধিশায়িত করায় কেব্ল অত্যধিক গরম হয়ে কেবলের ইনসুলেশন ক্ষয় হয়ে শর্টসার্কিট হওয়ার ঝুঁকির ভেতর রয়েছে অনেক ভবন। অনেক ভবনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড না মেনে বৈদ্যুতিক উপকরণ ও আনুষঙ্গিক উপকরণ স্থাপন করা হয়। যেমন টয়লেট এলাকায় সুইচ-সকেট দেওয়া, সাবস্টেশন রুমের আবশ্যিক শর্ত পূরণ না করে বৈদ্যুতিক উপকরণ স্থাপন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে যথাযথ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না করা। সার্কিট যখন সঠিকভাবে আর্থিং করা হয় না, তখন লিকেজ কারেন্ট মাটিতে যাওয়ার জন্য নিরাপদ পথ পায় না। ফলে বিপত্তি তৈরি হয়। অনুপযুক্ত নকশার কারণে আমাদের বেশির ভাগ উঁচু ভবনে কোড মেনে বজ্রপাত প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। এমনকি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন কম্পিউটার, টিভি ইত্যাদি রক্ষায় সার্জ প্রটেকটিভ ডিভাইস স্থাপন করা হয় না।
বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের অজ্ঞতা
বৈদ্যুতিক আগুনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ওভারলোডিং। যখন একই আউটলেটে একাধিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্লাগ-ইন করা হয়, তখন ওভারলোডেড হয়ে সার্কিট বা আউটলেট অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে, যা আগুনের কারণ হতে পারে। এক্সটেনশন কর্ড, পাওয়ার স্ট্রিপ বা আউটলেট কেনার সময় অভ্যন্তরীণ ওভারলোড প্রোটেকশন আছে কি না, তা দেখে নেওয়া উচিত। আমরা সচরাচর দেখি না। লাইট ফিকচারের অনুমোদিত ওয়াটের অধিক ওয়াটের বাল্ব স্থাপন আগুন লাগার আর একটি কারণ হলেও আমরা এ ক্ষেত্রে বড় বেশি উদাসীন। বহুদিন ব্যবহার করা পুরোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
অযোগ্য ঠিকাদার
মানসম্মত নিরাপদ ভবন তৈরিতে বৈদ্যুতিক ঠিকাদারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকাদার বা তাঁর প্রতিনিধিকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হতে হয়। তাঁদের অবশ্যই ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট, ওয়্যারিং সিস্টেম স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও পুরোনো ভবনের বৈদ্যুতিক কাজ আধুনিকায়ন করার যোগ্যতা থাকতে হবে। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তাবিষয়ক, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের ওপর প্রশিক্ষণ থাকবে। অযোগ্য জনবল নিয়োগকে নিরুৎসাহী করতে ঠিকাদারদের জন্য সঠিক নীতিমালা দরকার। বৈদ্যুতিক উপদেষ্টা ও প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শকের দপ্তরের মতে, একজন ঠিকাদারের অবশ্যই প্রয়োজনীয় টেস্ট ইকুইপমেন্ট, একজন সুপারভাইজার এবং ৫০ শতাংশ টেকনিশিয়ান বিদ্যুৎ লাইসেন্স বোর্ড থেকে সার্টিফিকেটধারী ও পারমিট ধারক হতে হবে। কাজ করার জন্য ঠিকাদারের যথেষ্ট সংখ্যায় প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান থাকতে হবে। বড় মাপের কাজের জন্য ঠিকাদারকে ন্যূনতম একজন স্নাতক প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে হবে। বৈদ্যুতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চোখ, মুখ, হাত–পা, মাথা ও শরীরের নিরাপত্তা বিধানে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম অপরিহার্য হলেও আমরা এ ক্ষেত্রে অমনোযোগী। দুর্ভাগ্য আমাদের, তদারকি বিশেষ করে এমইপি (মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং) সার্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষম লোকবল নিয়োগে অধিকাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অনীহা আছে। আর একটি কথা বলা দরকার, ভবন তদারকির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলীদের মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও জরুরি।
রক্ষণাবেক্ষণ
ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশন যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিদ্যুতের কারণে চলমান সমস্যা সম্পর্কে উদ্বেগ না থাকায় দৈনন্দিন পরিদর্শন এবং পরীক্ষা প্রতিনিয়ত আমরা উপেক্ষা করে চলেছি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে ভবনের ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশন নিরাপদ কি না, তা নিশ্চিতে সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা ভবনমালিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলেও তাঁরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন। অসমর্থ ব্যক্তির অনভিজ্ঞ পরামর্শে আস্থা রাখায় সৃষ্টি হয় গুরুতর দুর্ঘটনা। ইনডোর সাবস্টেশন রুমের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রুমের আশপাশে গাছ লাগানোকে নিরুৎসাহী করা হলেও আমরা আর্দ্রতা এমনকি ধূলিকণা বিবেচনায় নিই না। ২০ বছরের অধিক সেকেলে ওয়্যারিং আজকের বৈদ্যুতিক লোড নেওয়ার ক্ষমতা রাখে কি না, তা ভাবার অবকাশ কোথায়?
ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন কার্যকর ফায়ার ডিটেকশন ও প্রোটেকশন ব্যবস্থা। নিরাপদ নির্গমনে ফায়ার স্টেয়ার, ফায়ার এক্সিট লাইট, ফায়ার এক্সিট সাইনস ও প্রেশারাইজেশন সিস্টেমের জন্য প্রয়োজন অধিকতর সচেতনতা। অজ্ঞতা, অসতর্কতা ও অর্থনৈতিক কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে উত্তরণে দরকার সাংস্কৃতিক মান, যা আমরা অর্জন করতে পারিনি। পথ একটাই, নিয়মাবলি মেনে ভবন নির্মাণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। নিয়ম না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
আফজাল আহমেদ প্রকৌশলী, বৈদ্যুতিক পরামর্শক