মতামত

বেসরকারি চাকরিজীবীরা নিজেদের উন্নয়নে কেন পিছিয়ে থাকবে

‘বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব কারও নেই?’ লেখাটা প্রকাশ হওয়ার পর বেসরকারি খাতের অনেকেই মেইল করে অনেক কিছু জানিয়েছেন। সব থেকে বেশি চাওয়া ছিল এই ৯৫ শতাংশ মানুষদের জন্য নিয়মিত কিছু করার চেষ্টা করা। সেই সূত্রেই এই লেখাটি লিখেছি।

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮ তম। এটা কেন বলছি। যেখানে ব্যবসা করা কঠিন, সেখানে চাকরিজীবীদের কাজ করাও অবশ্যই কঠিন। আর আমাদের ব্যবসার কাজ ৯০ শতাংশই বেসরকারি খাতের। এক একজনের নিজের টার্গেট শেষ করতে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় তা বোঝাই যায়। আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা সাধারণ কথা চলে—উপযুক্ত যোগ্যপ্রার্থীর বড়ই অভাব। এদিকে দেশে বেকার সমস্যা বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশের মতো।

মহামারির আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। (বিবিসি ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। ধারণা করা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি উৎসে।
যেহেতু দেশে পুরোপুরি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নাই, আমাদের বেসরকারি খাতে যারা কাজ করছেন তাদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সব জিনিসে দীর্ঘসূত্রতা থেকে এই কাজের শুরু। সঙ্গে আছে যানজটের জন্য কর্মঘণ্টা নষ্ট। ৯ ঘণ্টার অফিস সময় দাঁড়িয়ে যায় ১২ ঘণ্টার ওপরে। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরেও নিজেদের অদক্ষতার জন্য প্রায় সবারই আরও দীর্ঘসময় অফিস করতে হয়। যা আরও অপচয়েরই নামান্তর।
কিন্তু কেন? পরিশ্রম করেও লাভ হচ্ছে না? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যারা বেসরকারি খাতের কর্মজীবী তাদের কাজের কিছু দিক তুলে ধরছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অভাব

আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরনের চাকরিজীবী আছে। ১. উচ্চাভিলাষী: এরা জানে কোন পজিশনে নিজেদের দেখতে চায়। সেই হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করে। ২. চাকরির জন্য কাজ করা: এরা এক পজিশনে থেকে বছরের পর বছর একই কাজ করে যায়। আর এই ধারার লোকই বেশি। এদের কোনো লক্ষ না থাকাতে কোম্পানিতে বাড়তি কিছু দিতে পারে না।

আপনি কোন দিকে যেতে চান

নিজের উন্নয়নের জন্য চিন্তা না করা: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার টাইমে একটা কথা খুব প্রযোজ্য ছিল, মেডিকেলে পড় নাই যেহেতু গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পড়া লাগবে না। কিন্তু পুরাই ভুয়া কথা। সময় বদলাচ্ছে, আর তার সঙ্গে আরও দ্রুত বদলাচ্ছে সবকিছু। আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে গেছে। কিন্তু নিজেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পড়তে হবেই। আগে বলা হতো, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার।’ এখন বদলে গেছে, ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার।’ আর পড়াশোনা না করলে এই ইনফরমেশন আসবেই না।

আর একটা চিন্তা হচ্ছে, অফিস ট্রেইনিং করালে করে, নিজে থেকে খরচ করতে চায় না। এদিকে দেশে নাই কার্যকরী এইচআর সিস্টেম (মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা)। ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেইনিং ইন্ডাস্ট্রির রিপোর্টে বছরে প্রতি জন চাকরিজীবীর জন্য ট্রেইনিংয়ের খরচ সব থেকে কম হলেও ৫৮১ ডলার। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো না হয় খরচ বাঁচাতে কিপটেমি করতেই পারে, নিজের দুর্বলতা দেখে নিজেরাও চাইলে ট্রেইনিং নেওয়া যায়। ডাক্তার বা অ্যাকাউন্টস প্রফেশনালরা কিন্তু নিজেদের পকেটের টাকা দিয়েই বিভিন্ন কোর্স করতে থাকে। তা ছাড়া এখন অনলাইননির্ভর অনেক ট্রেইনিং কোর্স সহজলভ্যও।

ভাষার দুর্বলতা

জাপান বা চীনের মতো আমরা মাতৃভাষায় স্বনির্ভর জাতি না। ফলে সেসব দেশের সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগে তাদের ভাষাতেই আমাদের কথা বলতে হয়। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আর আমাদের বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজিতে দুর্বল। কিন্তু এখন আর এক ভাষাতে নির্ভর করে বসে থাকলেও হচ্ছে না। জাপানিজ আর চীনা ভাষারও বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব বাড়ছে। যে যত ভাষা পারবে, কর্মক্ষেত্রে তার চাহিদা ও গুরুত্ব তত বাড়বে।

আমাদের দেশের মানুষ হাঁটা শুরু করে যখন সব অসুখ শরীরে জেঁকে বসে। এদিকে ঢাকা হয়ে আছে মানসিক চাপের শহর। কিন্তু যে কোনো কাজের জন্য সুস্বাস্থ্য দরকার। প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ১৫ মিনিট মেডিটেশন অনেকের থেকেই আপনাকে এগিয়ে দেবে।

শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা

আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ধারণা খুব একটা দেয় না। কার্যকরী ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব আছে। গতানুগতিক শিক্ষা যা আসলে কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা যে কোনো বিষয়ের স্নাতক পাসদের ডেস্ক জবে যতটুকু উৎসাহিত করে, মাঠ পর্যায়ের কাজে ততটাই নিরুৎসাহিত করে। সঙ্গে সিলেবাস হালনাগাদ বা সামঞ্জস্য না করে সবাইকে সময়ের সঙ্গে আরও পিছিয়ে দেওয়া হয়।

শারীরিক আর মানসিক ফিটনেস

আমাদের দেশের মানুষ হাঁটা শুরু করে যখন সব অসুখ শরীরে জেঁকে বসে। এদিকে ঢাকা হয়ে আছে মানসিক চাপের শহর। কিন্তু যে কোনো কাজের জন্য সুস্বাস্থ্য দরকার। প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ১৫ মিনিট মেডিটেশন অনেকের থেকেই আপনাকে এগিয়ে দেবে।

নিজের এসডব্লিউওটি (স্ট্রেংথ, উইকনেস, অপরচুনিটি, থ্রেট) ঠিক রাখা

অবাক হচ্ছেন? সব সময় তো কোম্পানির জন্য করেছেন। নিজের জন্য করেন এবার। নিজের স্ট্রেংথের (শক্তিমত্তা) ওপরে কাজ করবেন, উইকনেস (দুর্বলতা) কমাবেন, অপরচুনিটি (সুযোগ) কাজে লাগাবেন আর থ্রেট (ঝুঁকি) থেকে দূরে থাকবেন। নিজেকে ঠিকমতো জানার ওপরে কিছু নাই।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি বাংলাদেশের মানুষ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার লোকদের থেকে বেশি সময় অফিসে দেয়। কিন্তু আসল কাজে আমরা অনেক পিছিয়ে। হবেই না কেন? গ্লোবাল ইনোভেশন স্কেল ২০২১-এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২টি দেশের মধ্যে ১১৬তম। মানবসম্পদ মূলধন আর গবেষণাতে সেই অবস্থান দাঁড়ায় ১২৮ এ। আমাদের অফুরন্ত মানবদের সম্পদে পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা কোনো মাধ্যমেই হয় না—না সরকারিভাবে, বেসরকারিভাবে অথবা ব্যক্তিগতভাবে।

পরিশেষে সবার চিন্তার জন্য, একজনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) হতে গড়ে ২৪ বছর চাকরি করা লাগে। যারা মেধাবী তারা ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই হয়ে যায়, আপনি এখন কোন অবস্থানে আছেন?

  • সুবাইল বিন আলম একটি বিদেশি কোম্পানির কান্ট্রি ডিরেক্টর, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট এবং সাবেক রিসার্চ ফেলো। ই-মেইল: subail001@gmail.com