প্রথমে যাওয়া শুরু করলেন শ্রমিকেরা। তাঁরা ফিরে আসেন, টাকাও পাঠান। তাঁরা দেশের ভরসা। শিল্পীরা নাকি ভবিষ্যতের আভাস আগেভাগেই পান। নব্বই দশক থেকে যেতে থাকলেন অভিনয়শিল্পী-গায়ক ও সাহিত্যিকেরা। সাংস্কৃতিকভাবে তা দেশকে দুর্বল করেছে।
এরপর যাওয়া শুরু করলেন টাকাওয়ালা মানুষেরা। কেউ কেউ যাওয়া-আসার মধ্যে থাকলেও এখন বেশির ভাগই অন্য ভুবনের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রবাসী শ্রমিকেরা বাদে বাকিদের অধিকাংশই এখানে বানানো সম্পদ এখন বিদেশে রাখা শুরু করেছেন। দেশে তৈরি হওয়া এসব সম্পদ পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন সম্পদ তৈরি করে না, চাকরির সুযোগ বাড়ায় না।
কানাডার বেগমপাড়ার কথা এখন কে না জানে? পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু ধনী ও অতি ধনীর দ্বিতীয় ঠিকানা সেটা। কষ্ট করে টাকা বানাতে তাঁরা কষ্ট করে দেশে থাকবেন বটে। তবে তাঁদের দারা-পুত্র-পরিবার সেই টাকায় বিদেশে আলিশান জীবন কাটাবেন। কোনো মুশকিল নাই। যত দিন টাকা বানানো যাবে, তত দিন সাহেবেরা থাকবেন দেশে আর বেগমেরা থাকবেন বিদেশে। কিন্তু এখন সাহেবদেরও দেশ ছাড়ার খবর নিয়মিতই শোনা যাচ্ছে। স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বেগমপাড়ার বিপদ স্বীকার করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি বলেছেন, প্রাথমিক যে তথ্য তাঁরা পেয়েছেন তাতে তাঁরা দেখেছেন যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। তাঁর ভাষায়, ‘প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছে।’ ২৮টি ঘটনার তথ্য তাঁরা পেয়েছেন যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি। তাঁর মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম, কেবল ঋণখেলাপি, লুটেরা ব্যবসায়ীরাই নন, অনেক সরকারি কর্মকর্তাও বেগমপাড়ায় ঠিকানা করে নিয়েছেন। এই যাওয়া চাকরি বা ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন বাড়াবার যাওয়া না। এই যাওয়া সম্পদ পাচারের জন্য দেশত্যাগ। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। জাতিসংঘের সংস্থা আঙ্কটাডের হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের করের ৩৬ শতাংশই পাচার হয়।
কেবল বেগমেরা নন, সাহেবেরাও এখন প্রাণপ্রিয় স্বদেশে থাকা সাব্যস্ত করছেন না। অনেক বড় শিল্পগোষ্ঠী তাদের ব্যবসা ও অফিস নিয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়। অনেকে সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গেছেন ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায়। এটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জি-৭৭ ভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই প্রবণতার বাড়াবাড়ির কথা জানিয়েছে।
গরিব মানুষ কেন সীমান্ত পার হয়, কেন জঙ্গলে বা সাগরে ঘুরে বেড়ায়; তার ব্যাখ্যা আমরা জানি। দেশে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা নেই কিংবা যা আছে তাতে ভাগ্যবদল হয় না বলেই তাঁরা দেশ ছাড়েন। কারও হয়তো বিক্রি করার মতো জমি আছে, কিন্তু বিনিয়োগের নিশ্চিত ক্ষেত্র তাঁদের সামনে নেই। তারপরও গরিবের এই ছাড়া চিরতরে ছাড়া না। অভিবাসী শ্রমিকদের প্রায় সবাই-ই ফিরে আসেন। কিন্তু এলিট মহলের লোকেদের আপাতত ফেরার সম্ভাবনা কম। বিপুল পরিমাণ টাকা তছরুপ করা পি কে হালদারের মতো লোকেরা হয়তো অনুকূল সময়ে আবার ফিরতে পারেন। অনেকেই হয়তো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের অভিযোগ মাথায় নিয়ে ফিরতেই চাইবেন না।
উন্নয়নশীল দেশের ক্ষমতাবানেরা স্বদেশে আর ভবিষ্যৎ দেখতে পান না কখন? কখন তাঁরা বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যান, বিনিয়োগকারী কোটায় অন্য দেশে নাগরিকত্ব কেনেন। দেশে আর পরিবারও রাখেন না? এর শেষ ধাপ হলো সেই অশুভক্ষণ, যখন তাঁরা স্বদেশের নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন—যদি দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ না থাকে।
সমস্যাটাকে কেবল দুর্নীতির গণ্ডির মধ্যে আর ফেলে দেখা যাবে না। এটা দেশের অস্তিত্বের সমস্যা। রাজনৈতিক দিক বাদ দিয়েও বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক জায়গা থেকে প্রশ্ন জাগে, কখন দেশের সবচেয়ে ধনবান-ক্ষমতাবান নাগরিকেরা আর দেশে থাকা সমীচীন মনে করেন না? উন্নয়নশীল দেশের ক্ষমতাবানেরা স্বদেশে আর ভবিষ্যৎ দেখতে পান না কখন? কখন তাঁরা বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যান, বিনিয়োগকারী কোটায় অন্য দেশে নাগরিকত্ব কেনেন। দেশে আর পরিবারও রাখেন না? এর শেষ ধাপ হলো সেই অশুভক্ষণ, যখন তাঁরা স্বদেশের নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন—যদি দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ না থাকে। এই গল্পের সাহেব-বিবিদের সংখ্যা এখন চিন্তার চেয়েও বেশি, জানাশোনার চেয়েও ব্যাপক।
এসবের অর্থ কি এই, দেশের এলিট মহলে এই ভাবনা গেড়ে বসেছে যে এই দেশের ভবিষ্যৎ নেই? এখানে তাঁদের বানানো টাকা নিরাপদ না? নাকি এই পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন যে ভবিষ্যতে জবাবদিহির ভয়ে পালাচ্ছেন? তাঁরা আর এই দেশটাকে ‘আপন’ ভাবতে পারছেন না? সে কারণেই কি বেগমপাড়ার মতো ঘটনার জন্ম?
অর্থনীতিবিদেরা দুর্নীতির বিভিন্ন মাত্রা চিহ্নিত করেছেন। এর শেষ ধাপ হলো আত্মঘাতী দুর্নীতি। অতিমাত্রায় দুর্নীতির কারণে যখন আইন-রাজনীতি-প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা ভেঙে পড়তে থাকে, তখন পুঁজি অধিকতর নিরাপদ দেশের দিকে যাত্রা করে। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের যেসব কলকবজা ব্যবহার করে এসব দুর্নীতি ঘটেছে, সেসব যখন এলিটদের রক্ষার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন তাঁরা সেসব দেশের নাগরিকত্ব খোঁজেন বা সেসব দেশে বিনিয়োগ করেন, যেখানকার আইন-প্রতিষ্ঠান অটুট রয়েছে। এটাই হলো পরিহাস, অবৈধ সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে যাঁরা প্রতিষ্ঠান নষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁরাই আবার সেই সম্পদের পাহারার খাতিরে উন্নত দেশের আইন ও প্রতিষ্ঠানের ভরসায় পাততাড়ি গুটিয়ে সেসব দেশে চলে যান।
আমাদের দুর্নীতিবিরোধী আইন, অভিযানের শোচনীয় ব্যর্থতা এসব বেগমপাড়া অভিমুখী দেশান্তর।
উনিশ শতকের কলকাতায় রাজা রামমোহনের মতো মনীষীরাও ভাবা শুরু করেছিলেন, ‘সভ্য’ ও ‘আলোকিত’ ইংরেজরা একসময় এই দেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবে। তখন তারা এই ভারতবর্ষকে কেবল টাকা বানানোর কল ভাববে না, সাম্রাজ্যের মুকুট ভাববে না। ভারতবর্ষকে তাঁরা স্বদেশ ভাবা শুরু করবে এবং দেশের মঙ্গলে কাজ করবে। সেই স্বপ্ন সকালের শিশিরের মতো বাস্তবতা রোদের তাপে উবে গেছে। ইংরেজ রাজ সমৃদ্ধ বাংলাসহ ভারতবর্ষকে শুষে-ছিবড়ে নিয়ে গেছে। রেখে গেছে স্থায়ী দারিদ্র্য আর সামাজিক-রাজনৈতিক বিবাদের টেকসই নকশা।
উন্নয়নের কান্ডারিরাও এভাবেই পগারপার হবেন। কিন্তু যাঁদের যাওয়ার মতো আর কোনো দেশ নেই, তাঁদের তো এমন বাস্তবতা লাগবে, যেখানে বৈধভাবে টাকাও বানানো যাবে এবং সেই টাকা বিনিয়োগ করে আরও লাভবান হওয়ার সুযোগও থাকবে। এভাবে যে কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তা যুবকদের ভূমধ্যসাগরের ভেলায় কিংবা বসনিয়ার জঙ্গলে পাড়ি দেওয়া ঠেকাবে।
বেগমপাড়ার গল্প তাই দুর্নীতির গল্প না, তা দুর্নীতির শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলার আলামত। সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে মেরে ফেলার লক্ষণ। সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক ধসের ব্যারোমিটার হলো বেগমপাড়ামুখী অভিযান। এই পারদ আরও চড়ে গেরে প্রাতিষ্ঠানিক ধস ঠেকানোর আর কোনো উপায় থাকবে না। বেগমপাড়া যাঁদের গন্তব্য আর যাঁদের গন্তব্য বাংলাদেশ, তাঁদের ভবিষ্যৎ মোটেই এক হতে পারে না। বেগমপাড়ার ভূতেরা অর্থনীতির রক্ত চুষে খেতে থাকলে, বাংলাদেশর ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই আশা করা কঠিন হয়ে যাবে।
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
faruk.wasif@prothomalo.com