‘ভাই মাফ করেন, আমি বাচ্চার মা’। এই শুনে আসমান কেঁপে যাচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্রের পাষাণ মন অবিচল। গাড়ি চলছে, ঘোড়া চলছে, টেলিভিশন রঙ ছড়াচ্ছে। বেগমগঞ্জের সেই নারী, সেই মা, সেই স্ত্রী নির্যাতকদের পায়ে–পায়ে ঘুরে বলছে, ‘আমার মেয়েটা ছোট, ওরে অন্তত ছেড়ে দ্যান’। পাড়া-প্রতিবেশী তখন দুয়ার আটকে চুপ! ফেসবুকে যখন ‘চ্যালেঞ্জিং টাইমসের’ সেলিফসহ কতরকম চ্যালেঞ্জের মচ্ছব, তখন হায়েনার দল নারীমাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে আর উল্লাস করছে। মরবার আগপর্যন্ত মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে। বাঁচার চেষ্টায় ওই নারী কী–না করে গেলেন কিন্তু বাাঁচাবার কোনো হাত পাওয়া গেল না। আজ বেগমগঞ্জ, গতকাল সিলেট, তার আগে খাগড়াছড়ি, তার আগে খুলনা, তার আগে বগুড়া—কোথায় না? রাজধানী কত স্বাভাবিক। ‘চলো বন্দু ঘুরে আসি’ মেজাজে চলছে সবকিছু।
৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে যেন ধর্ষণের উৎসব, নারীর চিৎকার, শিশুর চিৎকার, মায়ের কান্না, অসহায় বাবার কলিজাফাটা আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ কুতুব মিনারের বাসিন্দাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। তাঁদের দিলে বিবেকহীনতার মোহর মারা। তবুও নারকীয় দৃশ্যের জন্ম হয়। ফেসবুকে-ইউটিউবে ছড়িয়ে যায় নারী নামের হরিণ শিকারের দৃশ্য। শিকারিদের বর্বর উল্লাস। সেই দৃশ্য দেখা যায় না, সেই কান্না শোনা যায় না, সেই উল্লাসে স্বাভাবিক প্রতিটি মানুষের অন্তরাত্মা ফুঁসে ওঠে ক্রোধে, হাহাকারে, বোবা যন্ত্রণায়। প্রতিটি লোমকূপে আগুন ধরিয়ে দেয় সেসব দৃশ্য। দৃশ্যগুলো তাড়াতাড়ি ঢেকে দেওয়া হয়, নির্যাতিতা মুখ লুকিয়ে ফেলেন, চলে যান অজ্ঞাতস্থানে। কিন্তু আমাদের ভুলে থাকার সাধনার দেয়ালে সেসব ছবি ফিরে আসে, ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। এ যেন আগেকার দিনের বোবা চলচ্চিত্র। পর্দায় মানুষের কান্নার মুখভঙ্গি দেখি কিন্তু শুনি উৎসবের মিউজিক। উন্নয়নের ব্যান্ডপার্টির অর্কেস্ট্রায় ঢাকা পড়ে নির্যাতিতার ফরিয়াদ।
সেই ফাঁকে ধর্ষক–নির্যাতকেরা বুক ফুলিয়ে হাঁটে। জনমতের মধ্যে তাদেরই ভাইবেরাদরেরা দোষ ধরে নারীদের পোশাকের, চালচলনের। সবাই ধর্ষক–নির্যাতক নয়। কিন্তু এত এত মানুষের মনে নারীবিদ্বেষ, এত হিংসার প্রচার, এত পুরুষালি আগ্রাসী মনোভাব। কোনো নারীর পেটের সন্তান ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। ধর্ষকের জন্ম নারীবিদ্বেষের এই সংস্কৃতির ঔরসে, রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তির ছাতার তলে, দুর্বৃত্ত রাজনীতির খামারে। ধর্ষকের মানসিক প্রশিক্ষণ দেয় যৌনায়িত হিন্দি মিডিয়া। সপরিবারে সেসবও দেখতে হয়।
এ এমন এক সময়, যখন জনগণের জনগণ ছাড়া আর কেউ নেই। সেই জনগণও পাশবিক ধর্ষকদের ক্ষমতার ভয়ে ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’ দশায় দিনাতিপাত করেছে। এক দিন নয়, দশ দিন নয়, বছরের পর বছর সয়ে যেতে হচ্ছে। আর কখন এমন অসহায়ত্বের লোমশ থাবার মধ্যে আমরা অবশ হয়ে ছিলাম? আর কখন ভাই হয়ে বোনের, মা হয়ে মেয়ের, বাবা হয়ে সন্তানের ওপর চলা বীভৎস নির্যাতন দেখে যেতে হয়েছে?
দেখতে না চাইলে জোর করে চোখ খুলে রাখা হয়েছে, যাতে নির্যাতকদের পাশবিক আনন্দ কানায় কানায় পূর্ণ হয়! এই দেশের মানুষ সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভোলেনি। পাকিস্তানি সেনারা তো এভাবেই তুলে নিয়ে যেত মেয়েদের। এভাবেই গেরস্তের নিজের বাড়িতেই তাঁদের কন্যা-স্ত্রীদের তারা ভোগ করেছে। সেই একই দৃশ্য ফিরে ফিরে আসছে আজকের বাংলাদেশে।
সেই যুগে ভিডিও ছিল না। তাই দূরে থাকা মানুষকে নির্যাতনের দৃশ্য দেখার ট্রমায় ভুগতে হয়নি। কিন্তু ভিডিওর কারণে আজ ১৭ কোটি মানুষ সেসব নারকীয় দৃশ্য দেখতে বাধ্য।নির্যাতন শিবিরে চোখের পাতা টেনে খুলে রেখে আপনজনকে তার প্রিয় মানুষের ওপর নির্যাতন দেখতে বাধ্য করা হতো। আমরাও দেখছি বদরক্যাম্পের দৃশ্য।
গ্রিক নাটকে রাজা অয়দিপাউস নিয়তির দোষে না জেনেই আপন মা-কে শয্যায় তুলে নিয়েছিলেন। যা দেখার কথা নয়, তা দেখার পাপ করেছিলেন। অয়দিপাউস যখন মা-কে চিনতে পারলেন, তখন যা দেখার কথা নয় তা দেখার পাপে নিজের দুই চোখ নিজেই অন্ধ করে ভিখিরির বেশে পথে নেমে গিয়েছিলেন। বেগমগঞ্জর নির্যাতিতা নারীর ভিডিও আমাদেরও দেখতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি দেখিনি, যাঁরা দেখেছেন তাঁদের রাগ-ক্ষোভ-হতাশা দেখেছি। যদি আমরা এ রকম আরেকটি ঘটনা ঠেকাতে না পারি, যদি আবারও আমাদের মানবতার সেই দোমড়ানো-মোচড়ানো, ছিন্নভিন্ন দেহ দেখতে বাধ্য করা হয়, অক্ষমতার পাপে কিংবা অনুশোচনার বিষে আমরা আমাদের কী শাস্তি দেব? কী জবাব দেবেন বেগমগঞ্জের গ্রামবাসী, যাঁরা নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ শুনেও লুকিয়ে ছিলেন দূরে?
নারকীয় পরিণতির সামনে দাঁড়িয়ে উল্লাস করা হায়েনাদের ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডেকে রেহাই ভিক্ষা করেছিলেন। মায়ের দাবি নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের পুরুষদের কানে যেন সেই ডাক তত দিন বাজে, যত দিন ধর্ষকের উল্লাসমঞ্চ থাকবে এই দেশ। যত দিন ধর্ষকেরা শাসকদলের বানানো ভয়ের পরিবেশে যাকে ইচ্ছা তাকে নির্যাতনের খায়েশ মেটাবে, যত দিন ক্ষমতার খুঁটির জোরে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে রাজনৈতিক বলে বলীয়ান দস্যুদের দাপট চলবে।
এ রকম এক ঘটনার সামনে দাঁড়িয়েই বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের যন্ত্রণাকাতর মন বলে উঠেছিল ঢাকার রোদন কবিতায়:
কালরাতে এই মহানগরীর আত্মার বিলাপে
অকস্মাৎ পাল্টে গিয়েছিল সব পুরুষের মুখের আদল।
ইস্তিরি করা ধূসর পাতলুন থেকে একে একে খসে গিয়েছিল
পৌরুষের সমস্ত বোতাম।
টিএসসির মোড় থেকে মূর্ছাতুরা ঢাকার ফোঁপানি
নপুংসক করেনি কি পৃথিবীর সমস্ত পিতাকে?
কারা পুত্র কে-বা পিতা? মাতা বধূ কন্যা কহ কারে?
হায়েনার দাঁত শুধু হামলে পড়ে-
আমাদের শতাব্দীর অনাবৃত লজ্জার ওপর।
শতাব্দীর উৎসব শেষ। ঢাকার মায়েরা
দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে ভেবে দেখো আগামী শতকে
আর কোনো পুরুষের জন্ম দিতে দীর্ণ করে দেবে কিনা
নিজের শরম।
মানুষী মায়ের গর্ভে এই দেশে আর কোনো
হায়েনার উদ্ভব না হোক।
কবিতার ঢাকার জায়গায় নিজ নিজ জনপদের নাম লিখুন, কুমিল্লার তনু, বগুড়া ও খুলনার মা-মেয়েকে ভাবুন, বসান বেগমগঞ্জ কি খাগড়াছড়ি কি সিলেটের নাম। দেখবেন, একদম মিলে যাচ্ছে। একদম মিলে যাচ্ছে জন্মভূমির ছবি, দেশমাতৃকার মুখ, আমাদের সময়ের মর্মান্তিক সংবাদগুলো।
যখন জনগণ শাসন বদলাতে পারে না, তখন শাসকেরাই জনগণকে বদলে দেয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ততন্ত্র আমাদের তরুণদের বদলে দিচ্ছে। টাকা, মাদক, নারী আর ক্ষমতার বিকৃত ভোগের হাতছানিতে তাদের ভেতরকার মনুষ্যত্বকে মেরে পুনর্জন্ম দিচ্ছে একাত্তরের ধর্ষক ও নির্যাতকদের। ক্ষমতাদণ্ডই এখন ধর্ষণদণ্ডে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার দণ্ডধারীরা জনপদকে উপদ্রুত ও আতঙ্কিত করে রেখেছে। সেই ক্ষমতার প্রশমন যদি না ঘটে, নারী নির্যাতনের নিরসন ঘটবে না। এটুকু বুঝতে সমাজবিজ্ঞানী বা অপরাধবিজ্ঞানী হতে হয় না। নির্বিচার ক্ষমতাকে চাপে রাখার মেকানিজম যদি রাষ্ট্রে না থাকে, সমাজ যদি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাতরাতে থাকে, তাহলে ক্ষমতার অজস্র ছানাপোনা সারা দেশকে ত্রাসিত ও নির্যাতিত করেই যাবে। মানুষের গর্ভেই তখন হায়েনাদের জন্ম হবে, সেই হায়েনারা অগম্য গমন করবে, যা করলে মানুষকে আর মানুষ বলা যায় না, তা করেও তাদের কোনো বিকার ঘটবে না।
বেগমগঞ্জের ঘটনায় সেটাই দেখা যায়। ৩২ দিন আগের ঘটনা তারা ভিডিও করে রেখেছিল এই উদ্দেশ্যে, ওই ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে ওই নারীকে দাসী বানিয়ে রাখবে, চাহিবামাত্রই তাকে নির্যাতনের মওকা মেলাবে। ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বলে চার নির্যাতক গ্রেপ্তার হয়েছে। সিলেটের ঘটনায় নির্যাতিতা নারী সাহস করে থানায় গেছেন বলে পুলিশ নড়তে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ক্যামেরার চোখের বাইরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, আরও বড় বড় লোকের দ্বারা যেসব অনাচার ঘটে, সেসবের কী হবে? দেখছি না বলে সেগুলো ঘটছে না?
এই সমস্যার সমাধান কী আদৌ সম্ভব, কীভাবে সম্ভব? প্রথম আলোর পাতায় এর উত্তর দিয়েছিলেন লেখক ও নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন। তাঁর প্রস্তাব: এক. ধর্ষকদের গায়ের রাজনীতির পোশাকটি (পরিচিতি) সরিয়ে ফেলুন বা পরতে দেবেন না। তাতেই ধর্ষণের সংখ্যা ৯০ ভাগ কমে যাবে। দুই. ইম্পিউনিটি, ‘আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকব, ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে আমার সংযোগ আছে’ এ রকম ভাবার সুযোগ বন্ধ করে দিন। আরও ৫টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। তিন. ক্ষমতার রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়া নারীরা রাজনীতির সুবিধাভোগী হয়ে এই দুই শ্রেণির দুষ্কর্মে নীরব থাকবে না, তা নিশ্চিত করুন, আরও ৪টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। চার. বাকি যে এক ভাগ ধর্ষক, ধরা যাক, হ্যাবিচুয়াল রেইপিস্ট বা স্বভাবগত যৌন অপরাধী, তারা দুষ্কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে। এমনকি আক্রান্ত নারীরাই তাদের কাবু করে ফেলতে পারবে। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যদি তাদের আস্থা জন্মায় যে দেশের মানুষ রাজনীতিকে ব্যবহারকারী গুন্ডাদের আর ভয় পাচ্ছে না।
এক মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা যখন শুধু লুটপাট চালাচ্ছিল, তখনো আমি কিছু করার কথা ভাবিনি। কিন্তু যখন তারা আমাদের ঘর থেকে মেয়েদের টেনে নিয়ে যেতে লাগল, তখন আমি যুদ্ধে গেলাম।’ অপরাধ চক্র আর ধর্ষক চক্র একযোগে একটা সামাজিক মানবিক যুদ্ধের সামনে আমাদের ঠেলে দিয়েছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে আমাদের আর পালাবার কোনো রাস্তা নেই। আপন ঘর আর আশ্রয় নয়। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। হায়, সেই ঘরেই আমাদের সবকিছু ধর্ষিত হচ্ছে আজ। আকাশও আর মুক্ত নয় যে আকাশে তাকিয়ে থাকব। সেখানেও নারীকণ্ঠের আর্তনাদের অফুরান প্রতিধ্বনি। শুনতে কি পান?
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও কবি।
faruk.wasif@prothomalo.com