বৃক্ষ নিয়ে কাজ করতে এসে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবণতা লক্ষ করছি। তা হলো, বৃক্ষ বাদ দিয়ে ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ নিয়ে মাতামাতি। এই প্রবণতা শুধু আমাদের দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও দৃশ্যমান। সারা বিশ্বের প্রকৃতিবিষয়ক নামীদামি সংস্থাগুলোর পক্ষপাতও কিন্তু বন্য প্রাণীর দিকেই। এমনকি সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলগুলোকেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বন্য প্রাণীর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করতে দেখা যায়;
যার উল্লেখযোগ্য অংশ আফ্রিকার সাফারি, সমুদ্র, পাখির আবাসস্থল, সাপ, কুমিরসহ বিচিত্র প্রাণীদের জীবনচক্রেই সীমাবদ্ধ। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বা অ্যানিমেল প্ল্যানেট পরিবেশিত এসব তথ্যচিত্রের কোনো দর্শক কমতি নেই। পৃথিবীর লাখো-কোটি মানুষ প্রতিদিন বেশ আগ্রহ নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করে।
আমাদের দেশেও বন্য প্রাণীবিষয়ক একাধিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে পাখি পর্যবেক্ষণমূলক সংগঠনই বেশি। আশার কথা যে দেশে প্রতিনিয়তই পাখিপ্রেমিকের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দল ভারী হচ্ছে প্রকৃতিপ্রেমীদেরও। প্রকৃতিপ্রেমীদের
সংখ্যা যত বাড়বে, ততই মঙ্গল। ধীরে ধীরে আমাদের দেশেও এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ছে। এখন ইচ্ছা করলেই স্পর্শকাতর কোনো স্থানের গাছ কাটা যায় না। পাখিও শিকার করা যায় না। সাধারণ মানুষই এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সবই ভালো লক্ষণ।
কিন্তু একটি বিষয় মনে হয় আমরা ভুলে যাচ্ছি, বন্য প্রাণী পৃথিবীর সমগ্র ইকোসিস্টেমের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। অথচ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয় যে বাকি সবকিছু গৌণ হয়ে ওঠে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সাগর, নদী, বন, পাহাড়, জলাশয় এবং বন্য প্রাণীর মতো বৃক্ষও বাস্তুসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৃক্ষ ছাড়া কোনো বন্য প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারে না। এমনকি অতি ক্ষুদ্র একটি পোকাও তার আশ্রয় ও খাবারের জন্য বৃক্ষ বা তৃণ-গুল্মের ওপর নির্ভরশীল। একটি পাখি যে গাছে বসে, বাসা বানায় বা যে গাছের ফল-পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে, সেই গাছটিই যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তাহলে পাখিটি কীভাবে বেঁচে থাকবে? কিন্তু এমন দরকারি একটি বিষয় নিয়ে আমাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। নেই কোনো বিশেষ গবেষণামূলক কার্যক্রমও। বড়জোর কোথাও কোথাও শুধু বৃক্ষ রক্ষার আন্দোলন হতে দেখা যায়, তা–ও খুবই সীমিত। সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পাখি বা প্রাণী পর্যবেক্ষক দেখা যায়, তার সিকি শতাংশও বৃক্ষ গবেষক দেখা যায় না। অথচ বন্য প্রাণীরা কেবল বৃক্ষের আশ্রয়েই বেঁচে থাকতে পারে। বৃক্ষ বা বন না থাকলে বন্য প্রাণীও থাকবে না—এই পরম সত্যটি বোধ করি অধিকাংশ প্রাণী বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন না।
বৃক্ষসম্পদ নিয়ে ব্যাপক তথ্য ঘাটতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ব্রিটিশ আমলের পর দেশে উদ্ভিদ নিয়ে আর কোনো ব্যাপক কাজ হয়নি। প্রায় দেড় শ বছর আগে জে ডি হুকার, উইলিয়াম রক্সবার্গ, নাথানিয়েল ওয়ালিচ, টমাস টমসন, জর্জ কিং, ডেভিড প্রেইন প্রমুখ ব্রিটিশ ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানী এ দেশে উদ্ভিদবিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করেন। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে দেশে নতুন আর কোনো পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদ সমীক্ষা হয়নি। স্বাধীনতার কিছু সময় পর ড. সালার খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম নিয়মিত মাঠ জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্তের কাজ শুরু করলেও এখন কার্যত তা বন্ধ রয়েছে। তাই আমাদের বৃক্ষসম্পদের একটি বড় অংশ এখনো হাতে কলমে দৃশ্যমান হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে পুরোনো তথ্য-উপাত্ত। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম থেকে রেড ডেটা বুক অব ভাসকুলার প্ল্যান্টস অব বাংলাদেশ নামে মাত্র একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিলুপ্তপ্রায়, বিপন্ন ও অরক্ষিত—এই তিন পর্যায়ের বেশ কিছু উদ্ভিদ প্রজাতির কথা বলা হয়েছে। তবে বইটিতে মাঠপর্যায়ের তথ্যে ঘাটতি থাকলেও বেশ কিছু বিপন্ন গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা দেখা যায় না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে কাজ করছে। সংস্থাটি বিপন্ন প্রাণী নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কিছু রেড ডেটা বুক প্রকাশ করেছে, যার অধিকাংশই বন্য প্রাণীবিষয়ক। কিন্তু দেশের সামগ্রিক উদ্ভিদ প্রজাতি নিয়ে ব্যাপক আঙ্গিকে কোনো প্রকাশনা নেই। প্রতিষ্ঠানটি মনে করে যে উদ্ভিদবিষয়ক গবেষণা বা প্রকাশনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর তেমন আগ্রহ নেই। বলা বাহুল্য, এ ধরনের সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দাতা সংস্থাগুলোর ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীতিমালা তৃতীয় বিশ্বের স্বাভাবিক উন্নয়নের পথে সহায়ক নয়, বরং প্রতিবন্ধক। আসলে যা কিছু থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বাহবা মিলবে, শুধু সেসবই তাদের আগ্রহ। প্রকৃতি বা পরিবেশ সমস্যার গভীরতর কোনো সমাধানে তারা আগ্রহী নয়।
৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকা শহরে মাত্র ১০০ বছর আগে কত বৃক্ষ ছিল বা কী ধরনের বৃক্ষ ছিল, তার কোনো তথ্য বা চিত্র আমাদের হাতে নেই। আবার ঠিক এই মুহূর্তে যদি কোনো ডকুমেন্টেশন না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও কারও গবেষণার জন্য কোনো তথ্য থাকবে না। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যেসব গাছপালা রয়েছে, তারও কোনো পরিসংখ্যান সিটি করপোরেশনের হাতে নেই। নগরে কীভাবে বৃক্ষবিন্যাস বা সজ্জাকরণ করতে হবে, এ বিষয়ে তাদের আগ্রহ বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই আছে বলে মনে হয় না। এটা শুধু ঢাকা নয়, গোটা দেশেরই চিত্র। অথচ আমাদের এই ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চল বৃক্ষ-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। সংখ্যাধিক্যে বিশাল এই বৃক্ষ প্রজাতির বিপরীতে পাখি ও অন্যান্য প্রাণী নিতান্তই কম। তবু সে ক্ষেত্রে একেবারে পূর্ণাঙ্গ না হলেও প্রায় কাছাকাছি একটি পরিসংখ্যান ও পরিচিতিমূলক তথ্য আমাদের গবেষকদের হাতে রয়েছে। কিন্তু বৃক্ষ প্রজাতি নিয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রকাশনা নেই বললেই চলে। শুধু প্রকাশনাই নয়, বৃক্ষসম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে কোনো উদ্যোগও নেই। আমরা যদি বৃক্ষ ও প্রাণসম্পদ ছাড়া প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান যেমন পাহাড়, নদী, সাগর ইত্যাদির দিকে তাকাই, তাহলেও আমাদের হতাশ হতে হবে।
এককভাবে কোনো একটি ক্ষুদ্র অংশ নয়, সমগ্র প্রাণবৈচিত্র্য বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের কর্তব্য। কারণ, প্রকৃতিতে প্রতিটি প্রাণই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ বাঁচলে যেমন পাখি ও পতঙ্গ বেঁচে থাকবে, তেমনি পাখি ও পতঙ্গ ছাড়া বৃক্ষেরও বংশবৃদ্ধি ঘটবে না। এই নিরেট সত্য আমাদের মানতেই হবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক; সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com