গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী ৬০ বছরে আরও প্রায় ১ শতাংশ ৫ ফুট বৃদ্ধি পাবে যা আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় ১৯ জেলার নয়টি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন অন্তত ৭ জন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। ইয়াসের প্রভাবে অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে, আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়েছেই। বেড়িবাঁধ ভেঙে অথবা বাঁধ উপচে নোনাজলে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৬৮২টি গ্রাম ও ৫০ টিরও বেশি চরাঞ্চল। ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।
২০২০ সালের ২০ মে, আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরা জেলার, আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রাম তলিয়ে যায়। সম্প্রতি দীর্ঘ দশ মাসের প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনী বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই দীর্ঘসময়ে অঞ্চলটির মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্যত্র। প্রতাপনগর ইউনিয়নের রাশেদার গল্পটা খুব করুণ। স্বামী নেই। সন্তানরাও যে যার মতো ছেড়ে গেছে। নদীতে রেণুপোনা ধরে চলে তাঁর সংসার। আম্পানে রাশেদার সব ভেসে গিয়েছিল। গেল দু-মাস হলো নিজের ভিটেতে ফিরেছেন। ভাঙা ঘর সোজা করেছেন। এবার আঘাত হেনেছে ইয়াস। কথায় কথায় রাশেদার কাছে জানা গেল, নিম্নচাপ ছাড়াও এখন এই অঞ্চলে অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় নদীর জল উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তাঁর আশঙ্কা, বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় হলে এই পুরো এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের বেড়িবাঁধগুলো ষাট-সত্তরের দশকে নির্মিত। সেসময়ে বড় দুইটি ঘূর্ণিঝড়ের পর জনজীবনের নিরাপত্তা ও কৃষি সুরক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল এসব বেড়িবাঁধ। দৈর্ঘ্যে এই বাঁধ ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। যার বড় অংশ আজ দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রায়। কার্যত এই দীর্ঘসময়ে ওই সব বেড়িবাঁধের কোনো উন্নয়ন হয়নি, তবে কখনো কখনো প্রচুর অর্থ অপচয় হয়েছে। অন্যদিকে নদীতে জমেছে প্রচুর পলি। বাঁধ ক্ষয়ে গেছে, বেড়েছে পানির উচ্চতাও। এর মধ্যে আগের তুলনায় অল্প সময়ের ব্যবধানে আঘাত হানছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। ফলে ওই পুরোনো বাঁধ দিয়ে এখন অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আটকানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র এক সমীক্ষায় বলছে, ২০৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য আরেকটি গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের ১৭ শতাংশ ভূমি হারিয়ে যাবে এবং এই সময়ে আমরা ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতা হারাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে এবং শুধু এই একটি কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রায় ২ শতাংশ ৫ কোটি। আরও দুঃখজনক খবর হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪৭ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ত্রিশ বছরে বাংলাদেশে ২৩৪টি ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ সময়ে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ক্রমাগত দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে লবণাক্ততা। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ হিসেবেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনাতীত। শুধু সিডরেই ক্ষতি হয়েছে জিডিপি’র অন্তত ৩% যা আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
ইয়াসের কিছু ছবি আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। অসংখ্য স্থানে বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সাধারণ মানুষ। পিঠ দিয়ে উত্তাল ঢেউ থামানোর চেষ্টা করেছে তারা। এসব প্রচেষ্টা কোথাও কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও হয়েছে ব্যর্থ। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অধিকাংশ সময়ই স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা এসব বাঁধ দিয়ে এভাবে আর কত দিন? এই ভাঙা-গড়ার খেলা আর কত দিন দেখতে হবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে? টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের আন্তরিকতার প্রচণ্ড অভাব কিংবা অনীহা আজ তাদের এই অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মোট ১৬ হাজার ২৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর, নাজুক।
জন্ম থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে করতে আজ ক্লান্ত। তারা এখন আর ত্রাণ চায় না, চায় পরিত্রাণ, চায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ। তারা আর বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচাতে চায় না, চায় সরকার তাদের বেড়িবাঁধ বেঁধে দিক। বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুক। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো ১৫-২০ ফুট উঁচু করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। প্রাক্কলন বলছে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণের জন্য ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এই অর্থ যদি আগামী পাঁচ বছর একটি প্রকল্পের আওতায় ব্যয় করা হয় তাহলে হয়তো ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ দিয়ে সেটা করা সম্ভব হবে। বাজেটে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হোক। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হওয়ার আগে বেড়িবাঁধগুলো বিনির্মাণ করা হোক।
উমর ফারুক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক।