বুকের মধ্যে ধিকিধিকি রানা প্লাজা

রানা প্লাজা
রানা প্লাজা

এ আগুন ক্ষোভের, কষ্টের। আবার এই শ্রমেই আগুনের ফুলকি এগোয়। নিভে যায় শ্রমিক। ২০১২ সালের তাজরীনে তারা জ্বলেছিল আর ২০১৩ সালে আগুনের শিখা নয়, তাদের ওপর ধসে পড়েছিল আস্ত ইমারত—রানা প্লাজার সমস্ত রড, ইটসহ পুরো ভবনটিই। তারপর বাক্সবন্দী লাশ হয়ে তারা সংখ্যা হয়ে যায়। হৃদয় আছড়ানো আর্তনাদ নিয়ে স্বজনেরা ছোটে ছবি বুকে নিয়ে, ছবির সঙ্গে সাদা কাপড়ে জড়ানো লাশটির মধ্যে লাগানো সংখ্যার ঘষাঘষি হয়, জন্ম হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বুকছেঁড়া কষ্টের, বিশ্বাসের—এটিই আমার স্বজনের লাশ। অনেকের লাশও মেলেনি। তেমনই এক নারীর ছবি দেখেছিলাম। মেয়ের ছবি বুকে চেপে আছড়ে পড়ে আছেন একটি কবরের ওপর। তিনি মেয়েটির লাশ পাননি। হাতে মাত্র একটি সিরিয়াল নম্বর। তাঁকে বলা হয়েছিল, ওই নম্বরের লাশটি ওখানে কবর দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক মেয়েটিকে দেখিনি, কিন্তু দেখেছিলাম সেই মাকে, যাঁর চোখ ডুবে ছিল একটি সিরিয়াল নম্বরের প্রতি আর তিনি কবরের নম্বর দেখে মিলাচ্ছিলেন তাঁর হাতে থাকা নম্বরটি।

এ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। হ্যাঁ, এ দেশেই, শ্রম দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সেদিন রানা প্লাজার আটতলা ভবন ধসে পড়ে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিকের। ৩০০ জন নিখোঁজ হয়েছেন এবং ২ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছিলেন। অথচ রানা প্লাজার মতো হৃদয় বিদীর্ণ করা ঘটনাকেও প্রথম কয়েক দিন সরকার ‘ঝাঁকুনি’তত্ত্ব দিয়ে মোড়কবদ্ধ করতে চেয়েছিল। তাই হয়তো জীবনগুলো শেষ হয়, বেঁচে থাকাদের জীবনও জীবন্মৃত হয়ে ওঠে, কিন্তু এখনো হলো না যেটি, তা হলো বিচার।

ক্ষতিপূরণ কি মিলেছে?
২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রানা প্লাজায় নিহত–নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে সরকারি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশ অনুয়ায়ী নিহত ও নিখোঁজ প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের পাওয়ার কথা দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। কিন্তু ওই টাকা দিতে রাজি হননি পোশাকশিল্পের মালিকরা। আহত শ্রমিকদের ভেঙে ভেঙে কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে, যেটা পরবর্তী সময়ে কিছু একটা করে জীবন চালানোর মতো কাজে আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে অর্থ শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে, সেটি ছিল অনুদান, ক্ষতিপূরণ নয়। যে হিসাব করে শ্রমিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে, তা খুবই সামান্য। আহত শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পরিমাণ ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। কারণ, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখনো মানসিকভাবে স্থির হননি। যে ভয়, আতঙ্ক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ততার স্মৃতি তাঁদের প্রতিনিয়তই নিয়ে যায় সেই দিনটিতে, সেই শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে, সেটি খুবই কম আলোচিত হয়েছে।

এখনো কাটেনি আঁধার
রানা প্লাজা বিষয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এ বছর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী আহত পোশাকশ্রমিকের ৫১ শতাংশ বর্তমানে বেকার। তাঁদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ শারীরিক ও ২৭ শতাংশ মানসিক দুর্বলতার কারণে কাজ করতে পারছে না। তবে আহত শ্রমিকদের ৪৯ শতাংশ পোশাক কারখানায়, টেইলারিং, দিনমজুরি, কৃষিসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। তাঁদের কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসাও করেন। আহত সাড়ে ২০ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তাঁরা মাথাব্যথা, হাত-পায়ে ব্যথা ও কোমরব্যথায় ভুগছেন। সাড়ে ২৮ শতাংশের অবস্থা ভালো। বাকি ৫১ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে প্রায়ই তাঁরা নানা সমস্যায় ভোগেন। আবার সাড়ে ১০ শতাংশ শ্রমিক মানসিকভাবে সুস্থ নন। সাড়ে ৬৮ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক অবস্থা কমবেশি স্থিতিশীল। আর ২১ শতাংশ শ্রমিক মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠেছেন। আহত শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ পুনরায় পোশাক কারখানার কাজে ফিরে গেছেন। তবে ২ শতাংশ শ্রমিক দিনমজুরি করছেন। আড়াই শতাংশ শ্রমিক বাসাবাড়ির কাজ করছেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ১৭ এপ্রিল ২০১৯)

সেই ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানার পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের উদ্বেগ এবং তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষে কারখানার বিদ্যুৎ ও অগ্নিনিরাপত্তা, অবকাঠামো ঝুঁকি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় উন্নয়নে কার্যক্রম শুরু করে ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এখন হয়তো পরিবেশ ও কারাখানা ভবনের উন্নতি হয়েছে। ভবনের ভেতরে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। তবে শ্রমিকের নিরাপত্তা শুধু কারখানা ভবন ও কারখানার ভেতরের যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা দিয়ে নিশ্চিত করা যায় না। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, আবাসন ও পরিবহন সুবিধা—সবই শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে খুবই গুরত্বপূর্ণ। সেদিকে উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনার কথা এখনো শোনা যায়নি। বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের বেতন এখন পর্যন্ত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম।

লাভের ভাগ পিঁপড়ায় খায়
দেশের জিডিপি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি এই শ্রমিকেরা। কারণ, তাঁরা ‘যখন-তখন’ রাস্তায় নেমে আসেন। এ কথা বললে খুব বেশি বলা হবে না যে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে খাতে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয় এবং সংগ্রাম জিইয়ে আছে, সেটি হলো গার্মেন্টস খাত। যদিও এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি খুব বেশি নেই। গবেষকেরা বলছেন, পাঁচ হাজারের বেশি পোশাক কারখানা। ৮৫ ভাগ পোশাক কারখানায় সঠিক ট্রেড ইউনিয়নই নেই। যা আছে তারও একটি বড় অংশ মালিকেরা তাঁদের পক্ষের নিজেদের লোক দিয়ে তৈরি করিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন করলে শ্রমিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কাজ থেকে ছাঁটাই হতে হয়।

সম্প্রতি অন্যান্য খাতের মতো গবেষণায় উঠে আসছে কারখানাগুলোয় নারী শ্রমিকদের প্রতি যৌন হয়রানির কথা। খুব কম কারখানাতেই করা হয়েছে যৌন হয়রানি অভিযোগ কমিটি। আরও আছে ওভারটাইমে বাধ্য করা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বেতন নিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তির ঘটনাও।

যে শ্রমের ওপর ভর করে একজন শ্রমিক এই দুনিয়ায় টিক থাকার স্বপ্ন দেখেন, সেই শ্রমকে মুহূর্তেই আগুন বানিয়ে ফেলে। সেই আগুনের স্পর্ধায় নেমে আসতে পারে রাস্তায়, প্রতিবাদী মনকে লাকড়ি বানিয়ে। আর তাই তো বড্ড ভয় হয় ওঁদের...

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com