ছবিটা এই রকম, বিহারের রাজধানী পাটনায় শয়ে শয়ে মানুষ ঝোলায় ভরা ডিএনএ নমুনা নিয়ে সরকারের ঘরে জমা দিতে মিছিল করে যাচ্ছে। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে বিহারে জন্মানো মহাপুরুষদের ছবি। গৌতম বুদ্ধ, বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ, মুন্সী প্রেমচন্দ, রামধারী সিং দিনকর...। মুখে স্লোগান, বিহারিদের অপমান বিহারবাসী সইবে না।
অপমান কেন? কারণ, বিহারে গিয়ে নির্বাচনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের ‘ডিএনএ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ওতে কোনো একটা গন্ডগোল নিশ্চয় আছে। ভোটের আগে আলটপকা বলা ওই কথাই লুফে নিলেন নিতীশ। বিহারি জাত্যভিমান হাতিয়ার করে মোদির ওই কথাকেই তিনি করে তুললেন ভোটে জেতার মোক্ষম হাতিয়ার। লাখ লাখ বিহারির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তিনি দিল্লি পাঠানোর সংকল্প করলেন। শুরু করলেন প্রচার, মোদি আপামর বিহারবাসীকে অপমান করেছেন। অতএব, ভোটের বাক্সে দিতে হবে তার জবাব।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বিজেপি অবস্থা সামাল দিতে মাঠে নেমেছে। কখনো প্রধানমন্ত্রী নিজে, কখনো দলের সভাপতি অমিত শাহ, কখনো বা বিহারের ভূমিপুত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ তাঁদের মতো করে ‘ডিএনএ’র ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। যেদিন পাটনায় মিছিল হলো, রবিশঙ্কর সেদিন বললেন, লালু প্রসাদ ও নিতীশ কুমারের ডিএনএ পরীক্ষা করা খুব দরকার। কেননা, এত বছর ধরে এত চুলোচুলির পর এখন তাঁরা বন্ধু–বন্ধু ভাব করছেন!
মোদ্দা কথা, বিহারের নির্বাচন এই মুহূর্তে ডিএনএর লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আসলে এসবই মূল খেলার আগে ওয়ার্মআপ। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দলের কাছে তিনটি ধাপ মোক্ষম: এই বছরে বিহার, ২০১৬-তে আসাম এবং ২০১৭–তে উত্তর প্রদেশ। এই তিন ধাপের যেকোনো একটি পেরোতে না পারলে সেটা তাঁদের কাছে হয়ে দাঁড়াবে বড় রাজনৈতিক ধাক্কা। উত্তর প্রদেশ নিয়ে এখনই ভাবনা নেই। কিন্তু বিহার ও আসাম এই মুহূর্তে মোদির মাছের চোখ। আপাতত যা অবস্থা, তাতে টেনিসের পরিভাষায় বলা যায়, বিহারে বেশ খানিকটা ও আসামে সামান্য ‘অ্যাডভান্টেজ বিজেপি’।
বিহারে বিজেপিকে এই ‘অ্যাডভান্টেজ’ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগটা কিন্তু লালু-নিতীশদের তৈরি করে দেওয়া। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে সাবেক সমাজতন্ত্রীরা পুরোনো জনতা পরিবারকে একজোট করে তোলার একটা চেষ্টা করেছিলেন। সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লালু প্রসাদ ও জনতা দলের (সংযুক্ত) নিতীশ কুমার ও শরদ যাদব ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন জনতা দলের (ধর্মনিরপেক্ষ) সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া। এঁরা ঠিক করেন বিজেপির রথ আর্যাবর্তে রুখতে গেলে একজোট হতেই হবে। তাই এই দলগুলো তো বটেই, সঙ্গে আরও কিছু ছোট দল নিয়ে তৈরি হবে নতুন দল, যে দলটি বিজেপির মোকাবিলায় নামবে। সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করাও হয়। মোটামুটিভাবে ঠিক হয়, নতুন দলের নাম হবে সমাজবাদী জনতা দল। আলোচনা চলতে থাকে দলের প্রতীক নিয়ে। ঠিক হয়, বিহারের ভোট হয়ে গেলে সরকারিভাবে বিষয়টি পাকাপাকি করে ফেলা হবে।
ঠিক এই সময়েই নেমে এল বিপর্যয়। মুলায়ম জানিয়ে দিলেন, বিহারে তাঁর দল এই জোট থেকে বেরিয়ে আসছে। তিনি অখুশি, কারণ, লালু, নিতীশ ও সোনিয়া গান্ধীরা কালনেমির লঙ্কা ভাগের পর যে কয়টি আসন ছেড়ে রেখেছিলেন, তা মুলায়ম ও শরদ পাওয়ারকে সন্তুষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। দুই নেতাই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আলাদা লড়বেন। এমন নয় যে মুলায়ম ও শরদ পাওয়ারের বাঁশির টানে বিহারের গাঁ-গঞ্জ থেকে লাখে লাখে মানুষ তাঁদের পিছু পিছু ঘর ছাড়বে। এই দুই দলের সমর্থন রাজ্যে অতীব কিঞ্চিৎ। কিন্তু বিন্দু বিন্দু জলেই তো সাগর!
বিহারে মুলায়ম-পাওয়ারের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিধর কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের পাশে পেতে তেমন কোনো চেষ্টা কিন্তু লালু-নিতীশ করলেন না। সিপিআইএর বেজায় আপত্তি লালুকে নিয়ে। বিজেপি ও লালু দুজনেই তাদের কাছে এখনো অচ্ছুত। দুই কমিউনিস্ট পার্টি এই রাজ্যে লালু-নিতীশ-সোনিয়ার জোটের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে বিজেপির রাতের ঘুম নিশ্চিতই উবে যেত। কিন্তু নিজস্ব জায়গির হারানোর আশঙ্কায় কমিউনিস্টরা পৃথক থাকার অযৌক্তিক এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজেপির পথ মসৃণ করে দিল।
বিজেপি এই মুহূর্তে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ ও স্বস্তিতে। স্বচ্ছন্দ, কারণ, তাদের তিন জোটসঙ্গীর মধ্যে রামবিলাস পাসোয়ান ও উপেন্দ্র কুশাওয়া আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে খুব একটা দরাদরি না করার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। নিতীশের ঘর ভেঙে আসা বিজেপির নতুন দোসর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জিতেন রাম মাঝি একটু বেঁকে বসেছেন। অত্যন্ত অনগ্রসর মানুষের এই নেতার দাবি অন্তত ৪০টি আসন। বিজেপি এই দাবির এক-চতুর্থাংশ মানে কি না, সেই আশঙ্কা জিতেন রামকে ইদানীং ঘিরছে। ফলে, লালুর সঙ্গে তিনি দর-কষাকষি শুরু করেছেন নতুন করে। বিহারের ভোট এখনো শতকরা ৮০ ভাগ জাতপাতকেন্দ্রিক। জাতপাতের সেই অঙ্ক ভুল প্রমাণিত হয়েছিল লোকসভার ভোটে। কিন্তু বিধানসভার ভোটে তেমনটা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেই দুই শিবির জাতভিত্তিক নেতাদের এত কল্কে দিচ্ছে।
বিশেষ করে বিহারের কথা মাথায় রেখেই মোদি এই অবসরে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমটি জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স বাতিল করা, দ্বিতীয়টি অবসরপ্রাপ্ত সেনানীদের দীর্ঘ চার দশকের দাবি ‘এক পদ এক পেনশন’ মেনে নেওয়া। দেশের যে কটি রাজ্য থেকে সেনাবাহিনীতে বেশি লোক যায়, সেগুলোর একটি হলো বিহার। অনেক টালবাহানার পর দাবি মেনে নেওয়ায় সাবেক সেনানীরা খুশি মনে অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ভোটের আগে মোদিও তাঁর পাগড়িতে আরও একটা রঙিন পালক গুঁজে নিলেন।
আগামী নভেম্বরে বিহারের ভোট সাঙ্গ হলে বিজেপি ঝাঁপাবে আসামে। ইতিমধ্যেই অবশ্য রাজ্য বিজেপি ঘর গোছানো শুরু করেছে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ যাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে ধীরে ধীরে মন্ত্রিসভার ২ নম্বর স্থানটি ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিদ্রোহ করে দল ছেড়েছেন। কিন্তু শুরুতে হিমন্তের সঙ্গে যতজন বিধায়ক ছিলেন, এখন রয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশ। হিমন্ত প্রভূত প্রভাবশালী হলেও তাঁর ভাবমূর্তি প্রশ্নাতীত নয়। এ নিয়ে বিজেপিতে যথেষ্ট উষ্মাও রয়েছে। কিন্তু আসাম দখলে মরিয়া বিজেপি এই মুহূর্তে ভাবমূর্তির চেয়ে সংখ্যাকে বেশি গুরুত্ব দিতে আগ্রহী। সেই সুযোগে হিমন্ত দলে তাঁর শাখা-প্রশাখা বিস্তারে উঠেপড়ে নেমেছেন। এ নিয়ে এত দিন ধরে রাজ্যে বিজেপি করে আসা নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। বিহারে জিতলে বিজেপিকে আসামের এই দিকগুলোয় নজর দিতে হবে।
তবে হিমন্তের ওপর নির্ভরশীল বিজেপির আসাম জেতা সহজ নয়। রাজ্যে বদরুদ্দিন আজমলের উপস্থিতি বড় বাধা। এ দেশে আতরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী বদরুদ্দিন আজমলের দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) শক্তি রাজ্যে দিন দিন বাড়ছে। এখনই তাদের রয়েছে ১৯ জন বিধায়ক। ১২৬ আসনের রাজ্য বিধানসভায় তারাই দ্বিতীয়। বিজেপির রয়েছে মাত্র ছয়টি আসন। হিমন্তের দরুন কংগ্রেস তার জেতা ৭৯ আসন ধরে রাখতে পারবে না, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও ঠিক, ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের দিকে বদরুদ্দিন আজমল যে শেষ মুহূর্তে সাহায্যের হাত বাড়াবেন না, তা হলফ করে বলা যায় না। নেতা ও প্রশাসক হিসেবে তরুণ গগৈয়ের ভাবমূর্তি এখনো অন্য সবার তুলনায় বেশি স্বচ্ছ।
বিহার ও আসামের ভোটে আর যাঁর প্রভাব অসীম হতে পারে, তাঁর নাম আসাউদ্দিন ওয়াইসি। হায়দরাবাদের এই রাজনীতিক যে দলটির সর্বেসর্বা, তার নাম অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম)। তাঁর বাবার গড়ে তোলা এই দলের শাখা-প্রশাখা আসাউদ্দিন এখন তেলেঙ্গনার বাইরে ছড়িয়ে দিতে চান। মহারাষ্ট্রে তিনি সফল হয়ে এবার বিহারের দিকে নজর দিয়েছেন। বিহারের সীমাঞ্চলের চার জেলা পূর্ণিয়া, কিষেনগঞ্জ, আরারিয়া ও কাটিহারে ইতিমধ্যেই বিশাল জনসভা করে এসেছেন। লালু-নিতীশদের এই গড়ে মুসলমান ভোট ভাগ হলে সবচেয়ে লাভ বিজেপির। আসাউদ্দিন তা বুঝে এখন জাঁতাকলে পিষছেন। কেউ কেউ তাঁকে এ জন্য ‘বিজেপিবান্ধব’ বলতেও ছাড়ছেন না। সম্প্রতি দিল্লি এসেছিলেন আসাউদ্দিন। জানিয়ে গেছেন, সীমাঞ্চলে জনসভা করেছেন ঠিকই, তবে প্রার্থী দেবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেননি। না দিলে লালু-নিতীশ-সোনিয়ার লাভ, বিজেপির ক্ষতি। আসামের ক্ষেত্রে এই আসাউদ্দিনই আবার বদরুদ্দিন আজমলের শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রয়োজনে এআইইউডিএফের হয়ে প্রচারেও রাজি জানিয়ে দিয়েছেন। আসাউদ্দিন হয়ে দাঁড়াচ্ছেন জেতা-হারার মধ্যবর্তী হাইফেন।
নরেন্দ্র মোদি কয়েক দশক ধরে ‘অবহেলিত’ বিহারকে ‘সুশাসনের রথের সওয়ারি’ করে তোলার হাঁক দিয়েছেন। নিতীশের কণ্ঠেও সেই ‘সুশাসনের’ স্লোগান। লালুর ‘মণ্ডল-রাজনীতির’ অবসান ঘটিয়ে গত ১০ বছরে নিতীশই বিহারের চাকার অভিমুখ উন্নয়নের দিকে ঘোরাতে পেরেছেন। এই লড়াইয়ে মোদির মতো তিনিও মোক্ষম বাজি খেলে ফেলেছেন। কে হারে কে জেতে, সেই উত্তেজনায় রাজনীতি খই ফোটা ফুটতে শুরু করেছে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।