৮ জানুয়ারি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পাওয়া ৮৪ জন মেধাবী তরুণের কথা লেখার পর ভুক্তভোগী অনেকে যোগাযোগ করেছেন। কেউ ই-মেইল করেছেন, কেউ টেলিফোনে প্রতিকারের উপায় জানতে চেয়েছেন। আবার কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী প্রথম আলো অফিসে এসে তাঁদের করুণ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আকুতি জানিয়েছেন, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করুন। আমরা অন্য চাকরি না নিয়ে বিসিএস পাস করে কি অন্যায় করেছি? সরকার চাকরি দেওয়ার বদলে এখন আমাদের “দেশদ্রোহী” হিসেবে চিহ্নিত করছে। এত বড় অন্যায় কি মেনে নেওয়া যায়? আমরা জনপ্রশাসনে ধরনা দিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করেছি।’
এই তরুণেরা সাধারণ তরুণ নন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেছেন। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) তাঁদের নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেই নিয়োগ আটকে দিয়েছে ‘নেতিবাচক পুলিশ রিপোর্টের’ দোহাই দিয়ে।
এই চাকরিপ্রার্থীরা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে প্রতিকার চাইলে জবাব আসে, তাদের কিছু করার নেই। ওপর থেকে নির্দেশ আছে। বাংলাদেশে এই ওপর যে কত ওপরে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
এই চাকরিপ্রার্থীদের চেহারা, বয়স, ঠিকানা ভিন্ন। পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থাও এক নয়। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পাওয়ার কষ্ট ও বেদনাটা অভিন্ন। আগের কলামে ৮৪ জনের কথা বলেছিলাম উচ্চ আদালতের রায়ের সূত্র ধরে। প্রথম আলোয় মোছাব্বের হোসেনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিসিএস উত্তীর্ণ কয়েক শ তরুণ চাকরিবঞ্চিত আছেন। এর মধ্যে ৩৭তম বিসিএসে ৬১ জন, ৩৫তম বিসিএসের ৩৪ জন, ৩৬তম বিসিএসে ৬৯ জন চাকরিবঞ্চিত আছেন। এ ছাড়া ২৩০ জন চিকিৎসকও বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো সদুত্তর পাননি।
যে দেশে আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধানের ভাই জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে যান, সে দেশে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট কীভাবে হয়, কাকে তারা দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী বানায়, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কৌতূহলোদ্দীপক হলো, নির্দিষ্ট বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিরত ব্যক্তিকেও নেতিবাচক পুলিশ রিপোর্ট দিয়ে নতুন পদে যোগদান আটকে দিয়েছে তারা।
সবার উচ্চ আদালতে রিট করার সামর্থ্যও নেই। এই চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে টিউশনি করে চলছেন। চাকরি না পাওয়ার লজ্জায় বাড়িতেও যেতে পারেন না। একজন ভুক্তভোগী বললেন, তাঁরা ধারকর্জ করে মামলার খরচ জোগাচ্ছেন এবং আশা করছেন একদিন ন্যায়বিচার পাবেন। বাংলাদেশে যেসব আইনজীবী মানবাধিকারের পক্ষে বিনা পয়সায় মামলা করেন, তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, রাষ্ট্রের মেধাবী সন্তানদের চাকরি না দেওয়ার চেয়ে বড় মানবাধিকার হরণ আর কী হতে পারে? এই তরুণদের জন্য কিছু করুন।
যে দেশে আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধানের ভাই জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে যান, সে দেশে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট কীভাবে হয়, কাকে তারা দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী বানায়, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কৌতূহলোদ্দীপক হলো, নির্দিষ্ট বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিরত ব্যক্তিকেও নেতিবাচক পুলিশ রিপোর্ট দিয়ে নতুন পদে যোগদান আটকে দিয়েছে তারা। ধরুন, একজন চাকরিপ্রার্থী বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা বা পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিলেন। তাঁর আশা ছিল প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ক্যাডার। তিনি পরবর্তী বিসিএস দিয়ে এর একটির জন্য মনোনীতও হলেন। অথচ তাঁর পুলিশ রিপোর্ট এল নেতিবাচক। ফলে তিনি আগের ক্যাডারে যথারীতি চাকরি করছেন। নতুন পদে যোগ দিতে পারছেন না। একই ব্যক্তিকে একবার পুলিশ রিপোর্টে সাচ্চা দেশপ্রেমিক ও সৎ চরিত্রের মানুষ বলে সনদ দিল, আরেকবার সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করল। বাংলাদেশে সবই সম্ভব।
মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। একটি উদাহরণ দিই। বরিশালের বারপাইকা গ্রামের রত্নপুর ইউনিয়নের আগৈলঝাড়া উপজেলার জিয়াউল হক শাহ ৩৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ পান। তাঁর বাবা মফসের আলী ২০১৫ সালে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। জিয়াউল অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, পুলিশের সাব–ইন্সপেক্টর ও রাজস্ব বোর্ডের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার চাকরিও পেয়েছিলেন। এখন এর একটিতে তিনি কাজ করছেন। এর আগে চারটি চাকরিতে তাঁর পুলিশ প্রতিবেদন ইতিবাচক এসেছে। অথচ এবার বিসিএসের বেলায় নেতিবাচক প্রতিবেদন এল। (প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর ২০২০)
হাইকোর্ট ৮৪ জন বিসিএস উত্তীর্ণকে নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়ার অর্থ এই নয় যে তাঁরা চাকরি পেয়ে গেছেন। এর আগে যাঁরা রিট করে হাইকোর্টে তাঁদের পক্ষে রায় পেয়েছিলেন, তাঁরাও চাকরি পাননি। সরকার আপিল করেছে। হাইকোর্টের নির্দেশের পরও সরকার আপিল করে যাঁদের নিয়োগ আটকে দিয়েছে, এটি চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি অমানবিক আচরণই বটে। তাঁরা চান দ্রুত আপিলের নিষ্পত্তি হোক। আপিল যত প্রলম্বিত হবে, তাঁদের চাকরি পাওয়ার আশা তত ক্ষীণ হতে থাকবে।
আগে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একটি সংস্থার রিপোর্ট নেওয়া হতো। এখন পুলিশের বিশেষ শাখার রিপোর্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট, মাঠ প্রশাসনের রিপোর্ট। সেখানেই শেষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্ব বিরাগভাজন হলে কারও পক্ষে বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব নয়। একজন দুঃখ করে বললেন, তাঁরা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাঁর বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর যখন পরিবারের সবাই আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, তখন এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘ও কীভাবে চাকরি পায়, আমি দেখে নেব।’ তাঁর বিশ্বাস, ওই আওয়ামী লীগ নেতাই তাঁর চাকরি আটকে দিয়েছেন।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে রিপোর্ট প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কারও সম্পর্কে পুলিশ ইতিবাচক রিপোর্ট দিল তো গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এল নেতিবাচক রিপোর্ট । আবার একজন সম্পর্কে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে ইতিবাচক রিপোর্ট পাওয়া গেল; কিন্তু প্রশাসন দিল নেতিবাচক রিপোর্ট। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেও অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একজন ভুক্তভোগী জানালেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি পুলিশ। লিখেছে, প্রার্থীর বাবা বিএনপিকে ভোট দিয়েছেন। বাবা বিএনপিকে ভোট দেওয়ার কারণে পুত্র বিসিএস পাস করেও চাকরি পাবেন না, এটি কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অনেকে যুক্তি দেখান যে বিএনপির আমলে অনেক আওয়ামী লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘুকে নেতিবাচক পুলিশ রিপোর্ট দিয়ে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিএনপি আমলে অন্যায় করা হলে সেটাই আওয়ামী লীগ অনুসরণ করবে কেন?
বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পদে যাঁরা আছেন, তাঁরা সামরিক শাসক এরশাদ কিংবা খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। দেশের মানুষ যখন স্বৈরাচারকে হটাতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন, তখন এই আমলারা নিয়োগ পেয়েছেন। এরপর ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপির আমলে এবং ২০০৭-২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও চাকরি করেছেন। সে সময়েও তাঁদের কর্মকাণ্ড দেশবাসী দেখেছে। এখন সবাই খাঁটি আওয়ামী লীগার হয়ে কার বাবা কাকে ভোট দিয়েছেন, কার চাচা কোন দলের সমর্থক—এসব অজুহাতে বিসিএস উত্তীর্ণ তরুণদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করছেন। রাজনীতির নামে মেধাবী তরুণদের প্রতি এত বড় জুলুম হতে পারে?
এই তরুণদের চাকরির মেয়াদ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। এখন তাঁরা যাবেন কোথায়? প্রথম আলো অফিসে আসা তরুণেরা বলেছেন, সরকার হয় তাঁদের পিএসসির সুপারিশ অনুযায়ী চাকরি দিক, না হয় কারাগারে পাঠাক। কারাগারে থাকলে অন্তত খাবারের চিন্তা করতে হবে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com