আইপিইএফে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আমেরিকার বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি
আইপিইএফে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আমেরিকার বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি

বিষাক্ত রাজনীতি বিশ্বে আমেরিকাকে খারাপ মিত্রে পরিণত করেছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর পাঁচ দিনের এশিয়া সফরে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক রূপরেখা (আইপিইএফ) জোটের ঘোষণা দিয়েছেন। ১২টি দেশ এই উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। চারটি ভিত্তির ওপর জোটটি গড়ে উঠছে—অর্থনৈতিক সংযোগ (তথ্য, শ্রম ও পরিবেশ), সরবরাহ শৃঙ্খল, পরিবেশসম্মত অর্থনীতি (কার্বনমুক্তকরণ) এবং স্বচ্ছ অর্থনীতি (কর, অর্থ পাচার রোধ)।

যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত আইপিইএফ গত জানুয়ারি মাসে চীনের নেতৃত্বে চালু হওয়া সমন্বিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বা রিসেপ থেকে দুর্বল একটি উদ্যোগ। কেননা রিসেপে সদস্যদেশগুলোর একে অন্যের বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু আইপিইএফে সেই সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নেতৃত্বে একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র আইপিইএফ জোটে আসা দেশগুলোকে তাদের বাজারে প্রবেশাধিকার দিতে পারত। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে এ ধরনের প্রস্তাব বাধার মুখে পড়ত না। শুধু আইপিইএফ নয়, একই  ধরনের দুর্বলতা বিশ্বজুড়ে আমেরিকার অন্য পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।

আইপিইএফে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আমেরিকার বাজারে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি, সেটা মোটেও বিস্ময়কর কোনো ঘটনা নয়। আমেরিকার এই রক্ষণশীলতা আত্মবিধ্বংসী। এ বিষয়ে দেশটির দুই দলের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে, সে কারণে কোনো প্রশ্নও উত্থাপিত হবে না। বাইডেনের অনুসারী ডেমোক্র্যাটরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুক্তবাণিজ্য তত্ত্বকে পুনরুত্থান করেছেন। বাইডেন প্রশাসন ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ বিল উত্থাপন করেছে, যদিও সেটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে অনুমোদন পায়নি। প্রস্তাবিত এ বিলটি কানাডার নীতিনির্ধারকদেরকেও ক্রুদ্ধ করেছে, কেননা এ বিলে এমন অনুচ্ছেদ আছে, যাতে কানাডার বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাইডেনের নিজের দলের একজন সিনেট সদস্যও তীব্র সমালোচনা করেছেন বিলটির।

আমেরিকার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে অংসগতিও দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত মাসে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিন-আমেরিকান সাংবাদিককে হত্যা করলেও সেই ঘটনায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, আমেরিকার বিদেশনীতিতে দেশটির বিষাক্ত রাজনীতির প্রভাব কতটা গভীর। এমনকি দেশটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। আর এ নীতির কারণেই আইপিইএফ-কে রং চড়িয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভারত ও ফিজি ছাড়া আইপিইএফের সদস্যদেশগুলো রিসেপেরও সদস্য। এর অর্থ হচ্ছে, আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বাইডেনের সফরে সিউল-ওয়াশিংটন যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়েছে, তাতে একবারও চীনের নাম নেওয়া হয়নি। এর কারণ হলো দক্ষিণ কোরিয়া তার বৃহত্তম ব্যবসা অংশীদারকে কোনোভাবেই খেপাতে রাজি নয়।

এ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই কূলই রক্ষা করে চলছে—তার বড় কারণ হচ্ছে, হোয়াইট হাউসে যে–ই আসুক না কেন, আমেরিকা ওই দেশগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য সঙ্গী নয়। ট্রাম্প প্রশাসন আন্তপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারত্ব (টিপিপি), প্যারিস চুক্তি, ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। জো বাইডেন প্রশাসন সেসব চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা দেখাচ্ছে না। এ কারণেই অকাস চুক্তি সম্পর্কে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক মাস আগে বলেছেন, এটি ‘পেছন থেকে ছুরি মারা’র মতো একটি ঘটনা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও রাশিয়ার ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউসের বর্তমান যে নীতি, তার ব্যতিক্রম হবে—সে রকম নিশ্চয়তা কম। যদিও ট্রাম্প এরই মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ‘সৃজনশীল পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্তৃপক্ষের পরামর্শ উপেক্ষা করে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ইরানের ক্ষেত্রে এই পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, তেহরান চায় তাদের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে ওয়াশিংটন যেন বাদ দেয়। নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্বর্তী নির্বাচন। এ অবস্থায় বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে পারমাণবিক চুক্তিতে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও এখন পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরা না ফেরা দিয়ে তেমন কিছু যায় আসে না। কেননা ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন থেকে সামান্য দূরে রয়েছে। গত কয়েক মাসে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধের বিস্তার হয়েছে। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক চুক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।

গণতন্ত্র কীভাবে একটি দেশকে গ্রাস করতে পারে, তার বড় একটি দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্র। বিচার বিভাগের মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে যে জট তৈরি হয়েছে, তাতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসন, বর্ণবাদ, গর্ভপাত ও এলজিবিটিকিউয়ের মতো ইস্যুতে কোনো অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া আর সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে অনুমোদন না পাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কটি দূতাবাসের পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। এতে বিদেশনীতি বাস্তবায়নে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আবার আমেরিকার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে অংসগতিও দেখা যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত মাসে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিন-আমেরিকান সাংবাদিককে হত্যা করলেও সেই ঘটনায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডস’ উদ্যোগের পাল্টা হিসাবে আমেরিকা ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এর কোনো কার্যক্রম কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আবার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক কর চুক্তিটিও আমেরিকার দূতিয়ালির কারণে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্থগিত হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যে বেঢপ প্রভাব তৈরির চেষ্টা করছে, তাতে বিশ্ব আরও কম নিরাপদ হয়ে উঠছে। আইপিইএফ গঠনের ঘোষণা আসা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সহযোগী দেশগুলো নিজেদের মতো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা ঠিক কাজটিই করছে।

  • জ্ঞানেশ কামাত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে