বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, গেস্টরুম-বিভীষিকা বন্ধ হোক

গেস্টরুম নির্যাতনে প্রাণ হারানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লাকে নিয়ে দেয়ালচিত্র
গেস্টরুম নির্যাতনে প্রাণ হারানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লাকে নিয়ে দেয়ালচিত্র

করোনা মহামারির কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলছে। শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। ধাপে ধাপে সশরীর ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আবাসিক হলগুলোও খুলে দেওয়া হচ্ছে। খুব শিগগির তাঁরা তাঁদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরবেন।

এই দেড় বছরে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যা হারিয়েছে, সেটা অপূরণীয়। এ ক্ষতি সামষ্টিক। ক্ষতি পুষিয়ে এখন নতুন করে আবার যাত্রা শুরুর সময়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের মূর্তিমান আতঙ্ক ‘গেস্টরুম’, ‘গণরুম’ প্রথা কি আবার ফিরে আসবে? আমরা যারা গত তিন দশকে গ্রাম, মফস্বল থেকে এসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, আবাসিক হলে থেকেছি, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সবচেয়ে ‘অবমাননাকর অধ্যায়’ এই গেস্টরুম-গণরুম। অপমান, লাঞ্ছনা, মারধর কিংবা গালিগালাজ সহ্য করতে হয়নি, এমন কোনো শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হলগুলোর গেস্টরুম শুধু ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর ‘টর্চার সেল’ নয়, এটা স্বপ্নবাজ তরুণদের ব্যক্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়ারও কেন্দ্র।

ক্ষমতাকেন্দ্রিক এ ধরনের চর্চায় শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র একটা অংশ সহপাঠীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল, সাবেক শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ—সবার চোখের সামনে দিনের পর দিন এটা ঘটে চলেছে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সবাই নিশ্চুপ। শুধু নির্যাতনে কারও মৃত্যু কিংবা বড় কোনো শারীরিক ক্ষতি হলেই কয়েক দিনের জন্য সবাই সরব হন। কিন্তু তারপর যা তা-ই। আবার একটা বড় কোনো দুর্ঘটনার জন্য সবার অপেক্ষা।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিশ্ববিদালয় শিক্ষার্থীদের ভূমিকা সব সময়ই অগ্রণী। নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন আন্দোলন পর্যন্ত ছাত্রদের এ ভূমিকা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক যুগে এ ভূমিকা নিচের দিকে নামতে শুরু করে। পরের তিন দশকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারা ছাত্রদের একটা অংশকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন-পীড়নের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের (ছাত্রদল হোক বা ছাত্রলীগ) নেতা-কর্মীদের হাতে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার শিকার হন। যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে হামেশাই। নব্বই-পরবর্তী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সিংহভাগই ধরনের দিক থেকে নিপীড়নবিরোধী। এ ধরনের আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা নেমে পড়েন। কারণ, তাঁদের প্রায় সবারই নিপীড়িত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আন্দোলনের মূল সুর একটাই। সেটা হচ্ছে, পড়ুয়ারা তাঁর সহপাঠী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিপীড়িত হতে চান না।

আমরা এখন উন্নত এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবে, তাদের ওপর দাসত্বের এক সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছি। বিশ্বের কোনো সভ্য সমাজ তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এ রকম প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে?

দেশের কর্তাব্যক্তিরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিংবা ডিজিটাল বিপ্লবের কথা বলছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিপীড়নমূলক চর্চা জারি রাখা হয়েছে। এ চর্চায় এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক সমমর্যাদার নয়, বরং আধিপত্যমূলক। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসেন। টিউশনি বা ছোটখাটো কাজ করে তাঁদের অনেকের চলতে হয়। ফলে হলে আসন না পেলে অনেকের পক্ষেই উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আসনের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এ সংকটকেই কাজে লাগায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য তারা গণরুম খুলে বসে। ছাত্রদের থাকার জন্য হলের বারান্দায় কিংবা অন্য কোথাও দেড় ফুট বাই পাঁচ ফুট জায়গা বরাদ্দ দেয়। ওইটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের বিনিময়ে শিক্ষার্থীর ইচ্ছা, অনিচ্ছা, মতপ্রকাশ, স্বাধীনতা—সবকিছুই যেন কিনে নেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের খাওয়া, ঘুমানো, পড়াশোনা, ক্লাস, পরীক্ষা—কোনো কিছুই আর যেন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আর এ ক্ষেত্রে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো।

আমরা এখন উন্নত এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবে, তাদের ওপর দাসত্বের এক সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছি। বিশ্বের কোনো সভ্য সমাজ তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এ রকম প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে?

গেস্টরুমের মতো প্রথা চালু রাখার মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমত গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভিন্নমত অনেক সময় ফোবিয়া বা ভীতি হিসেবে উপস্থিত হয়। ফলে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার নৃশংসতায় আমরা সবাই শিউরে উঠেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর পেছনেও দায়ী ছিল গেস্টরুমের মতো নির্যাতনকেন্দ্র। শীতের রাতে হলের কথিত ‘বড় ভাইয়েরা’ তাঁকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী এহসানের চোখ নষ্ট হয় গেস্টরুমের নির্যাতনের ফলেই।

সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজে যাঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তাঁদের কতজন লাভবান হচ্ছেন? বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগই দুকূল হারাচ্ছেন। নেতা হওয়ার দৌড়ে হাতে গোনা কয়েকজনেরই ভাগ্যের শিকে শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ছে। একদিকে পড়াশোনায় জলাঞ্জলি, অন্যদিকে রাজনীতিতে থিতু না হতে পারার ব্যর্থতা—ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারখানায় শুধু ব্যবহৃত হয়ে কত শিক্ষার্থীর জীবন বরবাদ হচ্ছে! আবার তাঁরা যখন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, তখন সে দায়ভার তাঁদের ওপরই এসে পড়ছে। আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে ঘৃণিত অপরাধ। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের কেউই কিন্তু এক দিনে দানব হয়ে ওঠেননি। আমরা দানব দমনের দাবি করছি। কিন্তু যে ব্যবস্থা দিনের পর দিন দানব উৎপাদন করছে, সেটা বন্ধের কথা ঘুণাক্ষরেও বলছি না।

শিক্ষার্থীদের ভয়ের পরিবেশে জিম্মি রেখে, তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত করে আর যা-ই হোক, একটা উন্নত সমাজ ও দেশের স্বপ্ন দেখা বাতুলতা। দেড় বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে শুরু করেছে। আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলগুলো কি পুরোনো চর্চা বাদ দিয়ে নতুন করে শুরুর চিন্তা করতে পারবে? তারা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নমুক্ত পরিবেশে গড়ে উঠতে দেবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ‘গেস্টরুম’ প্রথার মতো বিভীষিকার অবসান হওয়া জরুরি।

মনোজ দে: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক প্রথম আলো