বাংলাদেশের জনগণের এই মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী? চ্যালেঞ্জ হলো করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া। কীভাবে ও কত দিনে মুক্তি মিলবে, কেউ জানে না। সে ক্ষেত্রে করোনার সঙ্গে খাপ খাইয়েই আমাদের চলতে হবে। চ্যালেঞ্জ হলো করোনার কারণে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করা, যাঁরা নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন, তাঁদের দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসা। চ্যালেঞ্জ হলো শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতি ও জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা। দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব তা কাটিয়ে ওঠা।
দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্তমান সমস্যা উত্তরণের উপায় না খুঁজে অতীত চর্চাকেই আত্মরক্ষার মোক্ষম উপায় হিসেবে নিয়েছেন। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য অতীতের চর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, অতীতকে বদলাতে পারবেন না। ইতিহাসের বাঁক ফেরানো কোন ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, সেসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু কারও প্রতি এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যাতে একে অপরকে মুখ দেখাতেও লজ্জা পান। ইতিহাসে যাঁর যেটুকু ভূমিকা আছে, স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
২.
শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদেরা অনেক আগে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কয়েকটি ছাত্রসংগঠন ঘোষণা দিয়েছিল, ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে কঠোর কর্মসূচি নেওয়া হবে। তার আগেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছি।’ ওই দিন দুপুরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে মেডিকেল কলেজের প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। এরপরই রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে। এক দিনে এত সব ঘটনা ঘটল। অথচ বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জোর দাবি ওঠার পরও সরকার নির্বিকার ছিল।
গতকাল প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি।’ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি যত সহজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তত সহজ হবে না। কেননা সেখানে আবাসিক হলগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ছিল। কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ, পানির সংযোগও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এখন চাইলেও ১২ সেপ্টেম্বর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারবে না। তবে শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে এসে পরীক্ষা দিতে পারবে। কোনো কোনো বিশ্বিবদ্যালয় পরীক্ষার কাজটি শুরুও করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব স্তরের শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যেতেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করতেন। এ বিষয়টি সরকার আমলেই নেয়নি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব স্তরের শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যেতেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করতেন। এ বিষয়টি সরকার আমলেই নেয়নি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটানা বন্ধ আছে। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হার ১০ শতাংশে নেমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর আগে যখন সংক্রমণের হার ৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল, তখনো সরকার অজ্ঞাত কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করেনি। এবারের ডেলটা ধরনের করোনা শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর প্রধানত শহর এলাকায় সংক্রমণ ছিল। সে ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব একেবারে কম ছিল, সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন শিক্ষাবিদেরা। সরকার আমলে নেয়নি।
ধারণা করি, ১১ সেপ্টেম্বরের পর আর ছুটি থাকছে না; যদিও কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে মেডিকেল কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সমস্যা হলো কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বললেই সেটি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এর আগে যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রূপরেখা ঘোষণা করেছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছিল সবার শেষে।
গত ২৬ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরিকল্পনা করা হয়েছিল, টিকা দেওয়া সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরা আগামী ১৫ অক্টোবরের পর থেকে খুলতে পারবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ পরিবর্তন করা হতে পারে। প্রথম আলো সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, রোববারের বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি সর্বত্র ষড়যন্ত্র দেখে। দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে, এ খবরে সবাই স্বস্তি পেলেও ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতার কপালে ভাঁজ পড়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিকার অপ্রতুলতা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে টিকা দিয়েই ক্লাসে যেতে হবে। কিন্তু ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা কোনোভাবে সম্ভব হবে না। তাহলে কি শিক্ষার্থীরা টিকা ছাড়াই ক্লাসে যাবেন? তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হলো, অথচ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হলো না। এসব দেখে মনে হয় সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তৈরি পোশাকশিল্পকে যতটা গুরুত্ব দেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ততটা নয়।
৩.
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতি সর্বত্র ষড়যন্ত্র দেখে। দেড় বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে, এ খবরে সবাই স্বস্তি পেলেও ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতার কপালে ভাঁজ পড়েছে। তাঁরা আশঙ্কা করেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে তারা (ষড়যন্ত্রকারীরা) অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার হটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছাত্রলীগকে সজাগ থাকতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নয়, এ বিষয়ে ছাত্রলীগকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। ছাত্রলীগ সতর্ক থাকলে কী অবস্থা হয়, তা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো করেই জানেন। ছাত্রলীগ সরব আছে, অথচ কোনো অঘটন ঘটেনি, এ রকম কোনো উদাহরণ দেখাতে পারবেন কি আওয়ামী লীগের নেতারা? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যেদিন ছাত্রলীগকে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও নাশকতা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বললেন, সেদিনই যশোরের শার্শা উপজেলার ছাত্রলীগের নেতা আকুল হোসেন চার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচার দায়ে। তিনি এ পর্যন্ত দুই শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছেন। তাঁরা ভারত থেকে সীমান্ত পথে অস্ত্র সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জেলার সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেন। যে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ ধরনের অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সেই সংগঠনের হাতে ষড়যন্ত্র রোখার দায়িত্ব দেওয়া কতটা নিরাপদ, দেশবাসীই বিচার করবেন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com