নিজের জীবনে সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে, তা কে জানত! সত্যিই মনে হচ্ছে, ‘জীবনখানা ষোল আনাই মিছে’।
ভাবছেন, মিছেমিছি ভণিতা করছি! তবে শুনুন আসল কাহিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি বছর আটেক আগে। এখন পুরোদমে কর্মজীবী। কাজের সুবাদে একটা বই হাতে এল। বইটি ওলটানোর পর একটা ধাক্কা খেলাম। এই যে পাঁচ-সাত বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটালাম, দু-দুটো ডিগ্রি নিলাম, তার কী দাম আছে! বিশ্ববিদ্যালয় মানে কী, কীভাবে-কোথায়-কোন প্রেক্ষাপটে তার উৎপত্তি ও বিকাশ—এসবের কিছুই তো জানা হলো না।
জানা হবে কী করে? বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শুধু পাঠ্যবই গিলেছি। কীভাবে ভালো নম্বর পাওয়া যায়, তার জন্য ভূরি ভূরি রেফারেন্স দিয়ে নোট করেছি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে চোখ ছিল চাকরির গাইডে। এভাবেই শেষ মুক্তভাবে জ্ঞান অর্জনের এক মোক্ষম অধ্যায়ের।
‘বেটার লেট দ্যান নেভার’ বলে ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে। এই প্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সনদের প্রতি সুবিচার করতে হাতে আসা বইটি পড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বইয়ের নাম ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব’। লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটি বেরিয়েছে। বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
শুরুতেই লেখকের একটি তথ্যে আমার হীনম্মন্যতার অনুভূতি কিছুটা হলেও দূর হলো। বাংলাদেশ তো পরের কথা, পাশ্চাত্যের লোকেরাও ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের ব্যুৎপত্তি-উৎপত্তির ইতিহাস দিব্যি ভুলে বসে আছে। শুধু তা-ই নয়, মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ বলতে গিয়ে অহরহ ভুল করে।
ভুলে যাওয়া ও ভুল করার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। লেখক জানাচ্ছেন, এমন শব্দ খুব বেশি নেই। সংস্কৃত/বাংলা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি লাতিন ইউনিভার্সিতাস (universitas) শব্দের কৃতঋণ অনুবাদ। মজার বিষয় হলো বিদ্যা, বিদ্যায়তন বা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাতিন ইউনিভার্সিতাস শব্দের ন্যূনতম যোগসূত্রও ছিল না। ইউনিভার্সিতাস শব্দের মূল অর্থ একত্রকরণ, সংঘ, সমিতি বা গিল্ড ছিল। মধ্যযুগে নাপিত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সংঘ বা গিল্ড লাতিনে ইউনিভার্সিতাস নামে অভিহিত হতো। লাতিনে করপোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটিকেও ইউনিভার্সিতাস বলা হতো।
মধ্যযুগের ইউরোপে ইউনিভার্সিতাস শব্দের বিবিধ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ইতালিতে পেশাজীবীদের ইউনিভার্সিতাস (সমিতি) ছিল। সেখানে একাধিক গির্জার সংঘকে ইউনিভার্সিতাস বলা হতো। জার্মানিতে করপোরেট শহরকে বলা হতো ইউনিভার্সিতাস। কাল্পনিক পারলৌকিক সমিতিও ইউনিভার্সিতাস।
শিশির ভট্টাচার্য্যের বই থেকে জানা যায়, মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বের শুরুর দিকে (একাদশ-দ্বাদশ শতক) ইউরোপে ছাত্র ও শিক্ষকদের ইউনিভার্সিতাস (গিল্ড) গড়ে উঠেছিল। দ্বাদশ শতকের শেষ ও ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিতাস শব্দের একটি অর্থ ছিল—শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সমিতি। ক্রমে এই অর্থই ইউনিভার্সিতাস শব্দের একক অর্থ হয়ে যায়। তবে এই অর্থসংকোচনের কারণ ও প্রক্রিয়া অজানা।
মধ্যযুগের ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল বটে; কিন্তু সে সময় কোনটি বিশ্ববিদ্যালয়, আর কোনটি বিশ্ববিদ্যালয় না, তা শনাক্ত কঠিন ছিল। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা হচ্ছিল দেদার। এখন যেমন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দকেই বোঝায়, তখন এমন রীতি ছিল না। লেখক জানাচ্ছেন, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ বিদ্যালয় বলা হচ্ছিল। উত্তর ইউরোপে তা একাডেমি। জার্মান লেখকেরাও একাডেমি বলতেন। বিশ্ববিদ্যালয় বিকাশের শুরুর দিকে ইউনিভার্সিটি শব্দটি কোনো দলিলে ব্যবহৃত হতো না। তবে ছাত্র বা শিক্ষকসংঘ ইউনিভার্সিটি নামেই পরিচিত ছিল। একসময় ইউনিভার্সিটি শব্দের অর্থ তৈরি হয়—ডিগ্রি প্রদানে সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
লেখক তাঁর বইয়ে মধ্যযুগের ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ১৪টি কারণ দেখিয়েছেন। লেখকের যুক্তি, সে সময় ইউরোপ ছাড়া অন্য কোথাও সংশ্লিষ্ট নিয়ামকগুলোর উপস্থিতি ছিল না। তাই অন্য অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সূচনাপর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি মডেল থাকার কথা জানাচ্ছেন লেখক। এগুলো হলো—বোলোনিয়া মডেল (ইতালি) ও প্যারিস মডেল (ফ্রান্স)। এই দুই মডেলের সূচনা ও বিকাশ বর্ণনা করেছেন লেখক। বোলোনিয়া প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। কালক্রমে এটি বিলুপ্ত হয়। অন্যদিকে, প্যারিস মডেলকে ইউরোপসহ অন্যান্য অঞ্চলে অনুসৃত হতে দেখা যায়।
প্রসিদ্ধ অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার বিবরণ আছে বইটিতে। আছে মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বই, পাঠ্য বিষয়, শ্রেণিকক্ষ, ছাত্রাবাস, পরীক্ষা, সনদ, ঐতিহ্য ও সংকটের বিশদ আলোচনা।
লেখক শিশির ভট্টাচার্য্য অকপটে বলেছেন, তাঁর বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। বইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা ও ক্রমবিকাশের প্রথম ৩০০ বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে। সে যা-ই হোক, বাংলায় লেখা এই বই বাংলাভাষীদের কাছে মানবসভ্যতার এক প্রাচীনতম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম-ইতিহাস জানার আকর হিসেবে মূল্যায়িত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সাইফুল সামিন: সাংবাদিক
saiful.samin@yahoo.com