দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কেন উন্নত হচ্ছে না, কেন তারা এশিয়ার প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও উঠতে পারছে না—এ নিয়ে বাঙালি পণ্ডিতদের নানা তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। আশপাশের মধ্যে ভারত তো বটেই, পাকিস্তান এবং ছোট্ট দেশ শ্রীলঙ্কার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ওই তালিকায় থাকে। প্রতিবছর প্রথম ৫০০ বা প্রথম ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকা বের হওয়ার পর আত্মপক্ষ সমর্থনের হিড়িক পড়ে যায়। কেউ বলেন, ঠিকমতো ওই সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। কেউ বলেন, আমরা প্রচারে বিশ্বাসী নই।
বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ ‘আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে’—এ কথা বলে থাকলেও বাঙালিরা প্রচারবিমুখ—এটা মানা কঠিন। যেকোনো যাত্রাপথের দুই পাশে মোটাসোটা অজস্র বদনসংবলিত সহস্র পোস্টারই প্রমাণ করে আমরা খুব সস্তাভাবে আত্মপ্রচারকারী জাতি। কেউ বলেন, আমাদের উন্নতিতে অন্যের হিংসা হয়। সম্প্রতি পদস্থ ব্যক্তিদের মুখ দিয়ে অন্য বিষয়েও এই হিংসাতত্ত্ব বাণীর আকারে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার মান নির্ধারক সংস্থাগুলো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল বাদ দিয়ে শুধু আমাদের প্রতি হিংসান্বিত হয়ে উঠবে কেন—এটা বোঝা গেল না। এ-জাতীয় তত্ত্ব কিছুটা রাজনৈতিক সন্তুষ্টি শুধু আনতে পারে।
এসব আত্মসাফাইয়ের যুক্তি ও তত্ত্ব শুধু ভিত্তিহীন বা অসত্যই নয়, এগুলো আবর্জনাতুল্য। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের প্রধান বাধা এগুলোর ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ ও পদোন্নতির পদ্ধতি। এ কারণেই এগুলোয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বাসা বাঁধে—ঠিক যেমন পুরোনো ভাঙা দেয়ালের ফাটলে সাপের বাসা হয়। ঘুরিয়ে বলতে গেলে—ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই মানের তালিকায় উঠেছে, যেগুলোর নিয়োগ ও পদোন্নতির পদ্ধতি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তুলনীয়—বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক এবং সুস্পষ্টভাবে আমাদের থেকে আলাদা।
আমাদের পণ্ডিতেরা এ দুটো জায়গায় হাত দেন না বা আড়াল করে রাখেন। কারণ, তাঁরা নিজেরাই এই ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির সুবিধাপ্রাপ্ত অধ্যাপক। সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা এ জন্য দোষী নন—দোষ পদ্ধতির। গ্রামে দেখেছি মেট্রিক পাস করা মেধাবী ছাত্র মোড়লের বাড়িতে লজিং থাকে। ঘরজামাই হয়। তারপর মোড়ল তাকে টাকা দিয়ে শহর থেকে বিএ পাস করিয়ে আনেন। দ্বিতীয় রাস্তা হলো ওই মেধাবী ছাত্র নিজেই শহরে যায়, টিউশনি করে, বৃত্তি পায়, বিএ পাস করে এবং গ্রামে এসে মোড়লের মেয়েকে বিয়ে করে। দ্বিতীয় রাস্তাটিই পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবহার করে নিয়োগের ক্ষেত্রে। আগে নিজ চেষ্টায় উচ্চশিক্ষা বা পিএইচডি নিয়ে নিয়োগের বাজারে প্রবেশ করো—সেখান থেকে তোমাকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। একেই বলে যোগ্যতা যাচাই। যোগ্য লোক পদ পেলে যোগ্য অবদান রাখবেন—এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক নিয়োগে প্রথম রাস্তা, তথা কিঞ্চিৎ ‘ঘরজামাই’ পদ্ধতি অনুসরণ করে যাচ্ছে ৭০ বছর ধরে। ছাত্রের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করতে না করতেই আগাম ঠিক হয়ে যায় কাকে নেওয়া হবে বা হবে না। তখনই শুরু হয় দলাদলি ও তদবিরের বিভাগ অভ্যন্তরীণ কসরত। এ নিয়ে ব্যর্থ প্রার্থীর আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। প্রেমিক-প্রেমিকাও পছন্দ বদলায়। শুধু ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ ক্লাসে সর্বোচ্চ মেধাবী—এ ধারণা বিশ্বমানের শিক্ষালয়ে আর চলে না। ওভাবে কাউকে চিহ্নিত করার রীতিই উঠে গেছে। কারণ, মেধার মান বাতাসের তাপমাত্রা মাপার বিষয় নয় যে একে নির্দিষ্ট গাণিতিক সংখ্যায় প্রকাশ করা যাবে। গুণের বিচার সংখ্যায় হয় না।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক নিয়োগে প্রথম রাস্তা, তথা কিঞ্চিৎ ‘ঘরজামাই’ পদ্ধতি অনুসরণ করে যাচ্ছে ৭০ বছর ধরে। ছাত্রের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করতে না করতেই আগাম ঠিক হয়ে যায় কাকে নেওয়া হবে বা হবে না। তখনই শুরু হয় দলাদলি ও তদবিরের বিভাগ অভ্যন্তরীণ কসরত। এ নিয়ে ব্যর্থ প্রার্থীর আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। প্রেমিক-প্রেমিকাও পছন্দ বদলায়। শুধু ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ ক্লাসে সর্বোচ্চ মেধাবী—এ ধারণা বিশ্বমানের শিক্ষালয়ে আর চলে না। ওভাবে কাউকে চিহ্নিত করার রীতিই উঠে গেছে। কারণ, মেধার মান বাতাসের তাপমাত্রা মাপার বিষয় নয় যে একে নির্দিষ্ট গাণিতিক সংখ্যায় প্রকাশ করা যাবে। গুণের বিচার সংখ্যায় হয় না।
পক্ষান্তরে যখন পিএইচডিপ্রাপ্ত প্রার্থীরা নিয়োগের দরবারে হাজির হন, তখন পরীক্ষা করে দেখা হয় তাঁদের থিসিস বা অভিসন্দর্ভের প্রজ্ঞা, মৌলিকত্ব, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং বিভাগীয় সেবাদানের ঘটনা বা প্রতিশ্রুতি। তাঁদের বায়োডাটা বা ‘সিভি’-তে মাস্টার ডিগ্রির ফলাফল লেখা থাকে না। লেখা থাকে অনার্স-মাস্টার্সের বছর ও প্রতিষ্ঠানের নাম। নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হিসেবে স্বদেশের প্রার্থীদের দু-একটা সিভিতে দেখেছি, তাঁরা পারলে এসএসসি থেকে ফলাফল লেখা শুরু করেন। দোষ তাঁদের নয়। যে মনোভাবের বলয় থেকে তাঁরা এসেছেন, তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু সর্বদা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছেলেটির চূড়ান্ত ডিগ্রি বা পিএইচডির থিসিস প্রথম মানের কি না, তা যাচাইয়ের কোনো মানদণ্ড থাকে না। ওটার গুণগত মান যাচাইয়ের দায়িত্ব বিভিন্ন জার্নাল ও নিয়োগ পরিষদের সভ্যদের।
গত পাঁচ বছরে আমার একাধিকবার সুযোগ হয়েছে আপন বিভাগে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হওয়ার। এতে আমি পরম পুলকিত নই। কারণ নিয়োগদাতা হওয়ার অভিজ্ঞতা বিচারকের মতোই এক কঠিন দায়িত্ব। কোথাও যদি কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব প্রকাশিত হয়ে যায়, তাহলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। তদবির ও স্বজনপ্রীতির স্বর্গভূমির সন্তান আমি। কী জানি মনের অজান্তেই একটা মনোভাব আমার ভেতরে রয়ে যায়। ভয় হয়। চাকরি গেলে দেশে গিয়ে টিউশনি করা ছাড়া গতি থাকবে না। এখানে অধ্যাপক ও বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় অবসর—অনেকটা মহাভারতের ভীষ্মের স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো। এই দুই পেশার মানুষ চাইলে সারা জীবন চাকরি করতে পারেন। বলা বাহুল্য, এ দুই পেশায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও শুদ্ধাচারে বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি।
বিভাগে একজন সহকারী অধ্যাপক নেওয়া হবে। বিজ্ঞাপনের ভাষা দেখে দেবে জনসম্পদ বিভাগ। কোনো একটি শব্দ বা বাক্যে নিয়োগের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলা যাবে না। আশ্বস্ত করতে হবে এটি একটি সমসুযোগ বা ইকুয়াল অপরচুনিটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে কোনো জাত, পাত, লিঙ্গ, বর্ণ—এগুলোর বিভাজন হবে না। কারও ছবি আমরা চাইব না। তাই রূপে মুগ্ধ হওয়া বা শ্রীহীনতায় বিতৃষ্ণা হওয়ার সুযোগ নেই। প্রয়োজন নেই ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার কর্তৃক ছবি সত্যায়িত করার আদি বাধ্যবাধকতার।
বিভাগে একজন সহকারী অধ্যাপক নেওয়া হবে। বিজ্ঞাপনের ভাষা দেখে দেবে জনসম্পদ বিভাগ। কোনো একটি শব্দ বা বাক্যে নিয়োগের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলা যাবে না। আশ্বস্ত করতে হবে এটি একটি সমসুযোগ বা ইকুয়াল অপরচুনিটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে কোনো জাত, পাত, লিঙ্গ, বর্ণ—এগুলোর বিভাজন হবে না। কারও ছবি আমরা চাইব না। তাই রূপে মুগ্ধ হওয়া বা শ্রীহীনতায় বিতৃষ্ণা হওয়ার সুযোগ নেই। প্রয়োজন নেই ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার কর্তৃক ছবি সত্যায়িত করার আদি বাধ্যবাধকতার। অবশ্য জগন্নাথ হলে থাকতে ও রকম সিল প্রায় রুমেই থাকত। এবার একটি পদের জন্য ১৪০টি আবেদন পেলাম। প্রত্যেক প্রার্থী নিখরচায় কম্পিউটারে বসে আবেদন করেছেন। পাঠিয়েছেন একটি সিভি। এক পৃষ্ঠার ভূমিকায় আত্মপরিচয়: অতি সংক্ষেপে শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার কথা। অভিসন্দর্ভের সংক্ষিপ্তসার সেখানে আছে। দু-একটা রেফারেন্স লেটার—সেটিও প্রার্থীর শিক্ষকদের দেওয়া। এই যা।
যে পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন অধ্যাপকের এই বাছাই করা কমিটি। এতে চেয়ারম্যানের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। তিনি সময় হলে মতামত দেবেন মাত্র। কিন্তু নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবেন না। এই তিন অধ্যাপকের বাইরে আরও একজন অধ্যাপক কমিটিতে থাকবেন, যাঁর বিভাগ ভিন্ন। এটা অনেকটা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ‘এক্সটারনাল’ থাকার মতো। এই চারজনের প্রত্যেকেই ১৪০টি আবেদন দেখে ও পড়ে ২০ জনের একটা র্যাঙ্কিং করলেন। এবার আলাদা র্যাঙ্কিংগুলো যোগ করলে কমিটি চূড়ান্ত ২০ জনের তালিকা পায়—যাঁদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হবে।
মৌখিকের জন্য এই চূড়ান্ত তালিকা শুধুই যোগফল নয়। র্যাঙ্কিংয়ের নম্বর ও জবাবদিহিসাপেক্ষ। অন্যরা একজনকে চার বা পাঁচ দিল—আর আমি ‘এক’ দিলাম কেন? যদি ভুল বুঝতে পারি, তাহলে নম্বর সংশোধন করতে হবে। শুরু হলো ভাইবা। প্রত্যেক প্রার্থী ঠিক আধা ঘণ্টা করে সময় পেলেন। ভাইবা হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে। প্রার্থী কোথায় বসে ভাইবা দিচ্ছেন—জিজ্ঞাসা করা অশোভন। কথায় বুঝে নিলাম অধিকাংশই আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে। কয়েকজন ছিলেন বিদেশে। কেউ কেউ শ্রুতির মাধ্যমে সংযুক্ত হলেন। তাঁদের চেহারা দেখলাম না। তাতে কিছু না। কে বৃদ্ধ, কে জোয়ান—কিছুই বুঝলাম না। কখনো জেন্ডারও বোঝা যায় না। তাতে কী। শুধু বুঝতে হবে তাঁদের গবেষণা, প্রকাশনা ও শিক্ষকতার বিষয়।
এসব নিয়োগপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে যৌক্তিক বিষয় হচ্ছে ভাইবার প্রশ্নগুলোর অভিন্নতা ও বস্তুনিষ্ঠতা। প্রত্যেককেই মাত্র আটটি প্রশ্ন করা হবে—যা আগে থেকেই জনসম্পদ বিভাগের অনুমোদন পেয়েছে। ভাইবা নেওয়ার সময় কত বিষয়েই না খামাখা খোশগল্পের খায়েশ হয়েছিল। পারিনি। আমার বরাদ্দে যে দুটি প্রশ্ন, সেগুলোই করতে হবে। মুখস্থ হয়ে গেছে। স্বপ্নেও বলতে পারব। তারপর যাঁর যাঁর নোট নিলাম। সমস্ত ভাইবা ওয়েবেক্সে রেকর্ড হয়ে রইল। যদি কোনো দিন কেউ তাঁর প্রতি পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বলে মামলা দেন, তখন এই রেকর্ড খতিয়ে দেখা হবে।
প্রতিটি ভাইবার পর আমরা নিজেদের মতামত দিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ওই প্রার্থীর জন্য একটা র্যাঙ্কিং ও মার্ক ঠিক করলাম। এভাবে দুদিনে ২০ জনের ভাইবা শেষ করে প্রথম ৫ জনের চূড়ান্ত তালিকা দিলাম জনসম্পদ বিভাগে। ওরা প্রথম তিনজনকে আলাদা আলাদা করে ক্যাম্পাসে ডাকবে। প্রার্থী ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষা প্রশাসন ও বিভাগের সবার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়সূচি ধরে কথা বলবেন। একসময় একটা ক্লাসরুমে শিক্ষক ও ছাত্রদের সামনে তাঁর কর্মবাজারের গবেষণা বা জব মার্কেট পেপার—যা অভিসন্দর্ভের একটি রচনা—পরিবেশন করবেন। এটি এমন হতে হবে যেন ছাত্ররা বুঝতে পারেন। কারণ, সর্বশেষে ছাত্রদেরও মতামত নেওয়া হবে।
এভাবে তিনজন ক্যাম্পাস ভিজিট শেষ করলে এবার বিভাগীয় পূর্ণ সভা বসবে। এ পর্যায়ে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় কে সবচেয়ে ভালো বা কে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়। তর্ক শুরু হলে ভোটাভুটি হবে এবং অনুক্রম ঠিক হবে। প্রথম হওয়া প্রার্থীকে ফোন করলে তিনি যদি জানান ইতিমধ্যে আরেক জায়গায় কথা দিয়েছেন, তাহলে দ্বিতীয় স্থানের প্রার্থী ডাক পাবেন। এভাবে সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতো প্রার্থী নিয়োগ সম্পন্ন হবে।
নিয়োগের ওই দু-তিন মাসের মধ্যে কোনো প্রার্থী যদি নিয়োগ কমিটির কোনো সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে তাঁকে সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের প্রার্থীরা ভাইবার আগে বা পরে অনেক সময় যোগাযোগ করেন। আমি স্বদেশের পদস্থ ব্যক্তিদের মতো আচরণ করি, অর্থাৎ ই-মেইলের কোনো উত্তর দিই না, কিংবা ফোনের কলব্যাক করি না। নিয়োগ কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে আমি অন্তত দু-একবার ‘অভদ্র বা অহংকারী’ হওয়ার সুযোগ পাই।
নিয়োগ পাওয়ার পর আরেক পরীক্ষা শুরু হয় সাত বছরের জন্য—যার আগে পদ স্থায়ী হয় না। প্রতি দুই বছর পরপর গবেষণা, প্রকাশনা, বিভাগে সেবা ও ছাত্রদের পরামর্শ দান এবং শিক্ষকতার মূল্যায়নের পর চাকরি নবজীবন পায়। প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রদের শিক্ষক সম্বন্ধে মূল্যায়ন জমা দিতে হয় নবায়ন যাচাইকারী কমিটির হাতে। এভাবে নবায়ন ও পদোন্নতির বিশাল নথি জমা দিতে হয় বিভাগীয় কমিটির কাছে। তাদের সুপারিশ বা অপছন্দের মতামত যায় বিভাগের প্রধানের কাছে। তিনি তা পাঠান স্কুল বা ফ্যাকাল্টি কমিটির কাছে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার বিশেষজ্ঞরা আছেন। তাঁদের সুপারিশ যায় ডিনের হাতে। ডিনের মতামত যায় প্রভোস্টের হাতে। প্রভোস্টের সুপারিশ যায় বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতির হাতে। এবার প্রেসিডেন্টের চিঠি পেল বোঝা যাবে পদের নবায়ন বা পদোন্নতি হলো। এই স্তরগুলোর মধ্যে কোথাও নেতিবাচক রায় থাকলে প্রার্থীকে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়।
নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ার এই গল্প পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা মঞ্জুরি কমিশনের কাছে কোনো রূপকথা নয়। তাঁরা এসবই জানেন। কিন্তু আরোপ করতে নারাজ। কারণ বিদ্যমান দূষিত পদ্ধতির সুবিধাভোগীরা বেশি শক্তিশালী। তারপর আছে রাজনৈতিক সায়। পুলিশ-গোয়েন্দাও নাকি বাদ নেই। এখানে শিক্ষাগত নিয়োগে কোনো সিনেটরকে ফোন করতে শুনিনি। পুলিশ-গোয়েন্দার নামগন্ধও থাকে না। ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ার পথে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক ও অধ্যাপকদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু নিয়োগ ও পদোন্নতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তাঁদের উৎপাদনশীলতার তাগিদও কম। অগবেষণামূলক বিষয় নিয়েই তাঁদের গবেষণা করতে হয় বেশি। তাই মান্দারগাছ থেকে আর দারুচিনির গন্ধ বেরোয় না। র্যাঙ্কিংয়ের তালিকায় স্থান করার চেষ্টা, প্রবৃত্তি—কোনোটিই আর থাকে না। শিক্ষাক্ষেত্রে কল্যাণের স্বার্থে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষামানের উন্নতি আবশ্যক। তাই সর্বাগ্রে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও পদোন্নতিপদ্ধতির আশু সংস্কার অপরিহার্য।
ড. বিরূপাক্ষ পাল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড
ই-মেইল: birupakshapaul@gmail.com