মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কৃত্রিম জটিলতা কাটবে কীভাবে

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কখনোই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য অভিশাপ হতে পারে না। কিন্তু দৃশ্যত এই প্রথমবারের গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা মূলত সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম জটিলতা। আর এই জটিলতা তৈরিতে সহায়তা করেছে ভর্তি কমিটির অগোছালো সিদ্ধান্ত। তবে একদিক থেকে ভালো যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কমিটি সমন্বিত ভর্তির অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলো বুঝতে পেরেছে। আমার বিশ্বাস, কিছু পদক্ষেপ হাতে নিলেই কৃত্রিম এসব জটিলতা অনায়াসে দূর করা সম্ভব।

প্রথমত, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। কেউ আসবে আর কেউ আসবে না, তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার যে সুফল, তা ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা কখনোই পাবে না। বরং তা ক্ল্যাসিফায়েড হয়ে যাবে। তাই সবার আগে, সরকারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় নিয়ে আসা। তবে আশাব্যঞ্জক হচ্ছে, গতবারের চেয়ে এবার আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত হচ্ছে।

বর্তমানে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আদলেই বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো কয়েক দশক ধরে স্বতন্ত্রভাবে সফলতার সঙ্গে বিশেষায়িত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে যাচ্ছে। তারা যদি সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষাকেন্দ্র দিয়ে একই প্রশ্নপত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারছে, তখন দেশের প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই নিয়মের আওতায় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। ইতিমধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় কোনো জটিলতা ছাড়া তা গ্রহণ করতে পারলে অন্যদের সেই পথ দেখতে সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না।

আপনি যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক না–ও করতে পারেন, তাহলে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিনটি ক্যাটাগরি করতে পারেন। আর এসব ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থান পেতে আপনারা ৭৩ অ্যাক্ট অনুসরণকারী ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রামকে একটি ক্যাটাগরিতে আনতে পারেন। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যতীত অন্যরা। আর তৃতীয় ক্যাটাগরিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (যেখানে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে)। ফলে একজন শিক্ষার্থী তিনটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অদ্যাবধি মনে করছে, স্কুল ও কলেজের জিপিএ ভালো করে আসা শিক্ষার্থীরা মেধাবী। আর তাঁদেরকে ভর্তি করাতেই নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এ কারণে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার আগে বহুবিদ এই শর্তজালের ঘেরাটোপে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির শুরুতে ক্ল্যাসিফায়েড হয়ে যাচ্ছে। ফলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলতে গেলে জিপিএকে মুখ্য ভর্তি পরীক্ষার ফল যেমন তৈরি করছে, তেমনি নানা শর্তে বিভাগগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে, যা মোটেই সুখকর নয়। জিপিএকে বর্তমানে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে প্রাথমিক বাছাইয়ের কৌশল হিসেবে নিয়েছে, তা বজায় রাখা উচিত। তবে সব ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একই আবেদন যোগ্যতা থাকবে।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবেদনের যোগ্যতা অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেবে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার কেন্দ্র বাড়বে, তেমনি মূল পরীক্ষা থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী বের করে আনা সম্ভব। তবে লক্ষ রাখতে হবে যেন জিপিএ মেধা স্কোরে না স্থান পায়। আর সে জন্য জিপিএর দিকে নজর না দিয়ে, বরং প্রশ্নপত্রের মান বাড়ানো জরুরি। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা যাচাইয়ের জন্য এমসিকিউর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও নেওয়া যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল, অটোমাইগ্রেশনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। যেমন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছে ভর্তি হওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়, আবার বাতিল করতে হলেও আরও ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে এসব বাতিল প্রক্রিয়া সেরে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেশ ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এই ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সচল।

গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় আসন ফাঁকা থাকার যেসব কারণ বের হয়েছে, তা পর্যালোচনা করা। একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন তিন ক্যাটাগরিতে যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাহলে ক্যাটাগরি ‘এ’ ভর্তি পরীক্ষা আগে নেবে, তারপর ক্যাটাগরি ‘বি’ এবং সর্বশেষ ‘সি’। ‘এ’ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা দ্রুততম সময়ে ভর্তি শেষ করার পর ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। ফলে, ‘এ’ ও ‘বি’তে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চেয়েছে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যে ধরনের শিক্ষার্থী ডিজার্ভ করে, তা তারা পেয়ে যাবে। এরপর অন্যদের নিয়ে ‘সি’ ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে। তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্তর্ভুক্ত কলেজে ভর্তি শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে কলেজগুলো ‘এ’, ‘বি’ কিংবা ‘সি’ ক্যাটাগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় স্কোরধারী শিক্ষার্থীদেরও ভর্তিতে অগ্রাধিকার দেবে। এরপরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জিপিএর ওপর ভিত্তি করে অন্যদের ভর্তি করাবে। এই নীতি অনুসরণ করলে ভর্তি প্রক্রিয়া যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হবে, তেমনি ভর্তি হতে গিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে না।
গুচ্ছভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদন থেকে শুরু করে ভর্তি প্রক্রিয়ায় একই নীতি অনুসরণ করবে। এ ক্ষেত্রে ক্যাটাগরির ভর্তির আবেদন ফি একই যেমন হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফিও একই হতে হবে। ইউনিফাইড ভর্তি ফি না থাকলে বেশি ভর্তি ফি নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যেমন আগ্রহ কমবে, তেমনি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থাকার আশঙ্কা তৈরি হবে। আর সে জন্য ইউজিসির তালিকাভুক্ত সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একই অন্তত মূল ভর্তি প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে একই নীতিমালা অনুসরণ করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে।

পরবর্তী সেমিস্টার ও বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত তাদের বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কম-বেশি করতে পারে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে এই দেশের জনগণের টাকায়। তাই এখানে ব্যবসার মনোভাবের চেয়ে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতনে শিক্ষকতা করছেন, ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই বেতনে চাকরি করছেন শিক্ষকেরা। তাই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচও সমান্তরাল করা বাঞ্ছনীয়।

আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো একই নয়। ফলে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরের পর শিক্ষার্থীদের দেওয়া প্রতিষ্ঠানের পছন্দক্রম অনুসারে ভর্তির ফলাফল দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা যদি ৫০০ হয় আর ভর্তি পরীক্ষায় স্কোরধারীদের সংখ্যা যদি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দের তালিকায় ১ হাজার জন হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন মেধাতালিকা তৈরি করবে, তখন শিক্ষার্থীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত আসনের বিপরীতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকা করবেন, এই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় মানবণ্টনে থাকা বিষয়গুলোতে প্রাপ্ত নম্বরের সহায়তা নিতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের দেওয়া পছন্দক্রম অনুযায়ী একই সময়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া যেমন চলবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের মতো ঝামেলা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে।

শিক্ষার্থীদের পছন্দক্রমে পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিভাগগুলোতে ভর্তির ক্রম তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিভাগগুলোতে আবার শিক্ষার্থীদের পছন্দ ও স্কোর অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে অটোমাইগ্রেশনের প্রয়োজন পড়বে না। আর এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ইউনিফায়েড ওয়েবসাইট থাকা উচিত, যা ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ যেমন করতে পারবে, তেমনি এ ধরনের ওয়েবসাইট শিক্ষার্থীদের তথ্যের আধারও হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল, অটোমাইগ্রেশনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। যেমন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছে ভর্তি হওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়, আবার বাতিল করতে হলেও আরও ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে এসব বাতিল প্রক্রিয়া সেরে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেশ ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এই ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সচল। আমরা তা থেকে পরিত্রাণ চাই। আর সে জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ায় সমন্বিত উদ্যোগ।

আমরা চাই, উচ্চশিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আসুক। আর এই গুণগত পরিবর্তনের শুরুটা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া সহজীকরণ করে। সারা বছর ধরে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি করতেই থাকে, তাহলে সেটি একজন শিক্ষার্থীর যেমন ক্ষতি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও ক্ষতি। একই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস একটি নির্ধারিত সময়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া উচিত। বিশ্বের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষাবর্ষ ওরিয়েন্টেশন প্রায় একই সময়ে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে আমাদেরও পিছিয়ে থাকা সমীচীন হবে না। আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এই কাঠামো অনুসরণ করে, তাহলে একদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়ে যাবে, আধুনিকায়ন হবে উচ্চশিক্ষার প্রতিটি সিঁড়ি।

ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: nadim.ru@gmail.com