মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় কেন এই ভোগান্তি?

ভোগান্তি কমানোর কথা থাকলেও গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষায় ভোগান্তি আরও বেড়ে গেল
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক বছর ধরে যে বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় সবচেয়ে বেশি লেখালেখি করেছিলাম, তা হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘সমন্বিত ভর্তি’ পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট কমানোর জন্য এই ভর্তি পরীক্ষা যে সময়ের দাবি ছিল, সে বিষয়টি আমরা বারবার সামনে আনার চেষ্টা করেছি।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে প্রথমে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং পরে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আদলে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে। তবে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা উপেক্ষা করে পুরোনো নিয়মেই ভর্তি পরীক্ষা চালু রাখে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রথম দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেও পরে মত পাল্টে সেই পুরোনো ধারায় ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে যাচ্ছে তারা।

তবে শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্য প্রথমবারের মতো গত বছর গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় খাবি খেয়ে গেছে। নানার জটিলতায় এই ‘মহামূল্যবান’ গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষাকে কিছুটা বিতর্কের মধ্যে ফেলেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটি। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে একধরনের ভুল বার্তা গেছে। যদিও আমরা যেসব প্রস্তাব বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় দিয়েছি, তার আংশিক গ্রহণ করলেও বাস্তবায়নের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছুটা অদূরদর্শিতার কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যেসব প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিয়েছিল, সেসবের বাস্তবায়ন করতে পারলেও এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না।

গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার এই বিভ্রান্তি দূর করা না গেলে, ভবিষ্যতে এই পরীক্ষা নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হতে পারে। তাই সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার সুখকর অবস্থানগুলো তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়ার কাঠামোর আমূল সংশোধন আনা জরুরি।

গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় যা বলা হয়েছে

গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা তার এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার শাখা (বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য) মোতাবেক (একটিমাত্র) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। আর ভর্তি পরীক্ষার জন্য দুটি পর্যায়ে আবেদন করতে হবে—প্রাথমিক আবেদন এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিতরা চূড়ান্ত আবেদন করতে পারবেন। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞপ্তিটি বলছে, ৬০০ টাকা মূল্যের এই প্রাথমিক আবেদনে কেবল, এ (বিজ্ঞান) ইউনিটের জন্য এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান উভয় পরীক্ষায় (৪র্থ বিষয়সহ) প্রাপ্ত মোট জিপিএ–৮, বি (কলা) ইউনিটের জন্য জিপিএ–৭ এবং সি (বাণিজ্য) ইউনিটের শিক্ষার্থীদের জিপিএ–৭.৫০ থাকলে তাঁরা আবেদন করতে পারবেন। পরে ৬ ক্যাটাগরির মানদণ্ডে শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হবে।
প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ২৮টি ভর্তিকেন্দ্রে মূল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে, শিক্ষার্থীদের আবার আরেক দফায় কেন্দ্র বাছাইয়ের খপ্পরে পড়তে হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান, জিপিএ, পাসের বছর, ছেলে না মেয়ের ওপর ভিত্তি করে ১০০ নম্বর করা হয়েছে। প্রার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রের পছন্দক্রম এবং এই নম্বরের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মূল পরীক্ষায় প্রাপ্ত মেধাস্কোর অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরোপিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ভর্তি হতে পারবেন।

যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে

ওপরের গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষার এমন শর্ত মেনে শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তি হতে যাচ্ছেন, শুরুতে নানার বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাঁদের। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে নেওয়া গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় মহামারির কারণে পিছিয়ে গত বছর ১ এপ্রিল জিএসটি (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির আবেদন শুরু হয়। ২২ হাজার ১৩টি আসনের বিপরীতে এবার প্রাথমিকভাবে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০১ জন আবেদন করলেও যাচাই-বাছাই শেষে ২ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৫ জন ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ পান। প্রাথমিক নির্বাচনের পর ওই বছরই অক্টোবরে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যার ফলাফল ৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো বলছে, বিলম্বিত পরীক্ষার কারণে, অনেকে শিক্ষার্থীই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মেধাতালিকা প্রকাশের পর নির্ধারিত আসনে ভর্তি হচ্ছে না। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ৮-১০ বার অপেক্ষমাণ মেধাতালিকায় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও আসন পূর্ণ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমে বলছেন, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় থাকা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শর্ত পূরণ করতে গিয়ে যেমন হিমশিম খাচ্ছে, তেমনি আর্থিক ক্ষতিরও শিকার হচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএ মূল ভর্তি পরীক্ষার শর্ত পূরণের পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জিপিএ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মেধাস্কোর নিয়ে এগিয়ে থাকা কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার আবেদন যোগ্যতার জিপিএ ন্যূনতম শর্ত পূরণ করেও খেই পাচ্ছে না। ফলে তাঁরা আর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন না।

অন্যদিকে যাঁদের জিপিএ একটু ভালো, তাঁরা ঘুরেফিরে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যতা অর্জন করছেন। যার কারণে, সেখানেও একধরনের আসনশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনে করছে, ভর্তি পরীক্ষায় যতই ভালো স্কোর হোক, জিপিএ ভালো না থাকলে সে মেধাবী নয়। ফলে জিপিএতে ছাড় না দেওয়ার কারণে জিপিএ কম থাকা শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য সাড়া পাচ্ছে না।

এ ছাড়া গুচ্ছে মেধাস্কোরে থাকা শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার সময় প্রতিটি বিভাগে আলাদাভাবে অনলাইনে আবেদন করতে হচ্ছে, আর এই সব আবেদনে নেওয়া হচ্ছে টাকা, যা অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মনে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নেতিবাচক ধারনা তৈরি করেছে।

অন্যদিকে, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি শেষ করায়, গুচ্ছতে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীরা ভর্তির শঙ্কা থেকে জাতীয়তে ভর্তি হয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোতে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের ভর্তি বাতিলে মোটা অঙ্কের টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। যার কারণে, অনেক শিক্ষার্থী গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলেও ভর্তি হতে পারেননি।

ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। nadim.ru@gmail.com