গত বছর করোনার সংক্রমণ যখন তুঙ্গে, সে সময় ঢাকার একটি বিদ্যালয় বিক্রি হবে, এমন বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল, তেল, নুনের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি হতে আমরা দেখিনি। সে কারণে বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপনটি আমাদের বোধে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। বিধিনিষেধের কারণে ব্যয়ভার মেটাতে না পেরে আসবাবসহ বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয়টির পরিচালক। বিদ্যালয়টি বিক্রি করতে হবে বলে ওই পরিচালক ছিলেন আবেগাক্রান্ত। একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন কী করব বলেন? মানুষ সন্তানের লাশ ফেলে দেয় না? এখন আমাকে ওটাই মনে করতে হবে, আমার সন্তান মারা গেছে, আমাকে এটা ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে।’
কিন্তু এমন যদি হয়, একটা বিশ্ববিদ্যালয় পেলেপুষে বড় করা হয়েছে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে! যদিও বিক্রি হয়েছে, এমন শব্দ বলা আইনসম্মত হবে না, বলতে হবে হাতবদল হয়েছে। একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাড়ে আট একর জমিসহ সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হাতবদল হয়েছে। এ হাতবদলে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন পায় ২০১৫ সালে। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মকর্তার ভাষ্যে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন পাওয়ার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নারায়ণগঞ্জে সাড়ে আট একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৭ সাল থেকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের পক্ষ থেকে জমিসহ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য জোরেশোরে উদ্যোগ নেওয়া হয়। (হাতবদল হলো আরও এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: দৈনিক বণিক বার্তা: ২৯ অক্টোবর ২০২১)
ইউরোপে যখন আধুনিক ঘরানার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তখনই এর সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন ধারণা পোক্তভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যৎ সমাজ বিনির্মাণে উপযুক্ত মানুষ তৈরি করে, ফলে এর দায়বদ্ধতা সমাজের কাছে। সে জন্যই এটা স্বায়ত্তশাসিত। রাষ্ট্র, সরকার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, অর্থনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে পারবে না। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারণার সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা, হাতবদল, বেচাবিক্রি ধারণা একেবারেই সাংঘর্ষিক।
এর আগে, করোনা মহামারির মধ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরেকটি শিল্প গ্রুপের কাছে হাতবদল হয়েছিল ঢাকার আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা হওয়া উচিত কি না, এ নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। ইউরোপে যখন আধুনিক ঘরানার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তখনই এর সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন ধারণা পোক্তভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যৎ সমাজ বিনির্মাণে উপযুক্ত মানুষ তৈরি করে, ফলে এর দায়বদ্ধতা সমাজের কাছে। সে জন্যই এটা স্বায়ত্তশাসিত। রাষ্ট্র, সরকার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, অর্থনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে পারবে না। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারণার সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা, হাতবদল, বেচাবিক্রি ধারণা একেবারেই সাংঘর্ষিক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বদল হয়েছে। করপোরেট পুঁজি এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। অর্থনৈতিক এ পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয় মালিকানার ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে, গত শতকের সত্তরের দশকের শেষে মুক্তবাজার অর্থনীতির খোলা পথ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ও গবেষণার নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়। ফলে অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। বেসরকারি মালিকানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা উচ্চ মুনাফাদায়ী পণ্য হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়।
কয়েক দশক আগেও সমাজের বিত্তবানেরা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বিস্তারে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করতেন। তাঁরা শিক্ষানুরাগী হিসেবে সমাজে সম্মানিত হতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্দেশ্য থাকত জনহিতৈষিতা। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এ ধরনের শিক্ষানুরাগীর দেওয়া জমিতে কিংবা তাঁদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত। সেগুলোর ব্যয় নির্বাহও হয়েছে তাঁদের সম্পদেই। সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে এখন তাঁদের তুলনায় বিত্তে ধনী মানুষের সংখ্যা অজস্র। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা জনহিতে বিত্তবানদের ভূমিকা নেমে এসেছে হতদরিদ্রের কাতারে। পুরোনো সেই শিক্ষানুরাগীদের বদলে এখন আমাদের সমাজে নব্য শিক্ষানুরাগীদের আবির্ভাব ঘটেছে। যাঁদের অনেকের উদ্দেশ্যই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাগিয়ে নেওয়া।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নিজস্ব আয়ে চলার পরামর্শের নামে বেনিয়াকরণের ব্যবস্থাপত্র ও চাপ নানা সময়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০০৬ সালে একটা কৌশলপত্রও তৈরি করেছিল। নিজস্ব আয় মানে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। এত টিউশন ফি দিয়ে কীভাবে পড়বে? এর জন্য ব্যাংক থেকে শিক্ষাঋণ দেওয়ার একটা পদ্ধতিও সেখানে খোলা রাখা হয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে নিজস্ব আয়ে। এ আয় কোথা থেকে আসে? শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টিউশন ফিসহ অন্যান্য ফি থেকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া ফির কত অংশ শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যয় করা হবে, আর কতটা মুনাফা করা যাবে, তার কি কোনো বিধিবিধান আছে? আবার কোন কোর্স বা কোন প্রোগ্রামে টিউশন ফি কত, সেটাই-বা কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? ওই যে খোলা বাজার নীতি। যেটার জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি সেটার ব্যয়ভার বেশি। আর যেটার চাহিদার চেয়ে জোগান কম, সেটার বাজারমূল্য কম।
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১০ সালে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ পাস করে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অনিয়ম, অসংগতিই যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে ইউজিসির পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে আর কোনটায় নিজ দায়িত্বে পড়তে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা কী দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে? কী কী বিবেচনায় তাদের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে? অন্তত আলু-পটোল-বিক্রির মতো বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রির উদ্দেশ্য যাদের থাকে, তাদের হাত থেকে তো নাগরিকদের মুক্তির একটা পথ থাকতে হবে? অতি মুনাফার উদ্দেশ্য যেখানে বাস্তবতা, সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে থাকা গোষ্ঠীই যে বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন, তা আর নতুন কী। ক্ষমতার বলয়ের অধিষ্ঠান মানে ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে’। প্রচলিত আইনকানুনের ধার তাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।
১৯৯২ সালে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে ১০৮টি, আর শিক্ষার কার্যক্রম চলছে ৯৯টিতে। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১০ সালে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ পাস করে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অনিয়ম, অসংগতিই যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে ইউজিসির পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে আর কোনটায় নিজ দায়িত্বে পড়তে হবে।
গণবিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যাচ্ছে, ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কারও কারও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। কেউ কেউ আদালতের স্থগিতাদেশে পরিচালিত। কেউ কেউ আবার অনুমোদিত শিক্ষা প্রোগ্রামের বাইরেও কিছু কিছু প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ক্যাম্পাস অনুমোদন ছাড়াই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এসব তথ্য দিয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এ ছাড়া যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নেই, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।
ইউজিসি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় সারছে। কিন্তু শিক্ষার মান কতটা রক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষার পরিবেশ কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কতটা সুযোগ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন, তা দেখবে কোন কর্তৃপক্ষ? ইউজিসির গণবিজ্ঞপ্তিতেই দেখা যাচ্ছে, তিন ভাগের এক ভাগের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুতর অনিয়ম রয়েছে, মানে সেখানে ভর্তি হওয়া যাবে না।
আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আদি ধারণা কী, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা কতটা ঠিক, এসব দার্শনিক বিতর্ক বাদ দিয়ে স্রেফ যদি আমরা সরল একটা প্রশ্ন করি, কাদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে যে তারা সেটা চালানোর মতো যোগ্যতা রাখে না? বিশ্ববিদ্যালয়কে যাদের বাজারে তুলতে হয়? বিষয়টি অভিনব, কিংবা আনকোরা বলেই আমরা এখন হয়তো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। কিন্তু যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যেভাবে অনিয়ম সেখানে নিয়ম হয়েছে, তাতে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো দারাজ, ইভ্যালি কিংবা অন্য কোনো মার্কেটপ্লেসে বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রির জন্য তোলা হতে পারে। ভাবছি, তখন ইউজিসি কী ধরনের গণবিজ্ঞপ্তি দিতে পারে?
মনোজ দে, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক