বিশ্বজুড়ে বয়ে যেতে পারে ক্ষুধার মহাস্রোত

যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি সম্প্রতি বলেছেন, ব্রিটেনে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ‘বিপর্যয়কর’ স্তরের দিকে যাচ্ছে। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিচ্ছে, সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বেইলি এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এ আশঙ্কা আরও বড়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কয়েক মাস ধরে বড় বড় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ বলে আসছেন, টাইডাল ওয়েভ বা মহাজলোচ্ছ্বাসের মতো ক্ষুধার একটি মহাপ্রবাহ বিশ্বজুড়ে বয়ে যেতে পারে।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের মানবিক ত্রাণকর্মীরা ক্ষুধার কারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গেল সপ্তাহে আবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের সংস্থা এবং মানবিক ত্রাণকর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো সম্ভাব্য মৃত্যুর খরচ।’ তিনি বলেছেন, ‘অপুষ্টি, ব্যাপক মাত্রার ক্ষুধা এবং দুর্ভিক্ষ এমন একটি সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে, যা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী তা দীর্ঘমেয়াদি মন্দার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।’

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আন্দাজ করছে, প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ জরুরি পর্যায়ের ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে এবং ৮১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলজুড়ে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে থাকা মানুষের সংখ্যা কোভিড-১৯–এর আগের তুলনায় এখন ১০ গুণ বেশি। বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধ গম, ভুট্টা, বার্লি ও সূর্যমুখী তেলের মতো প্রধান পণ্যগুলোর প্রাপ্যতা এবং দামের ওপর চরম বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

এ বছর ইউক্রেনের গম উৎপাদন ৩৫ শতাংশ কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাশিয়া কৃষ্ণসাগর অবরোধ করে রাখার কারণে ইউক্রেনের পক্ষে উৎপাদিত গম রপ্তানি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মার্চ মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দ্বারা নথিভুক্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দাম এখনো রেকর্ড ভাঙা অবস্থাতেই রয়েছে।

খাদ্য ‘দুর্যোগ’ নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে দরিদ্র জনগণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধনী ব্যক্তিরা অপমানিত হতে পারেন। একটি ক্ষুধার্ত বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক সংকট, অস্থিতিশীলতা এবং ভূকৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ পূর্ব খাদ্যঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতাকে এ যুদ্ধ আরও জটিল বা ত্বরান্বিত করেছে। এর বাইরে আছে মহামারির নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব; মহামারির কারণে সরবরাহ-শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়া, কর্মসংস্থান সংকট ও পরিবহন সমস্যা; জলবায়ু-সংকট-সম্পর্কিত উৎপাদন হ্রাস; জ্বালানি খরচের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী চলমান অন্যান্য অসংখ্য সংঘাত-সংঘর্ষ।

আন্তর্জাতিক ঝুঁকি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলেক্রফ্ট গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, মিসর ও ব্রাজিলের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে মোকাবিলা করার বিষয়ে ব্যতিক্রমীভাবে দুর্বল। এই শ্রেণির অনেক দেশের সরকার কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাদের আর্থিক এবং বস্তুগত রিজার্ভ নিঃশেষ করে ফেলেছে এবং বড় ধরনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, আর্জেন্টিনা, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। চলতি ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এ দেশগুলোসহ অনেক মধ্য বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে নাগরিক অস্থিরতার উচ্চ ঝুঁকি আছে।

খাদ্য ‘দুর্যোগ’ নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে দরিদ্র জনগণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধনী ব্যক্তিরা অপমানিত হতে পারেন। একটি ক্ষুধার্ত বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক সংকট, অস্থিতিশীলতা এবং ভূকৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাবারের দুষ্প্রাপ্যতা, বিদ্যুতের ব্ল্যাক আউট এবং পেট্রল, রান্নার গ্যাস এবং ওষুধের ঘাটতি শ্রীলঙ্কায় একটি রাজনৈতিক সংকটকে উসকে দিয়েছে। এর জের ধরে কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এরপরও সংকটের সমাধান হয়নি। সেখানে খাবার ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের সংকটে সামাজিক অস্থিরতা চলছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানের সরে যাওয়ার পেছনে যতগুলো কারণ কাজ করেছে, তার মধ্যে দুই সংখ্যার মুদ্রাস্ফীতি একটি বড় কারণ। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক পাকিস্তানিদের মৌলিক খাদ্যসামগ্রী কেনার ক্ষমতা হারিয়েছেন। দমনমূলক শাসন, দুর্নীতি, অযোগ্যতা, মেরুকরণ—পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে দীর্ঘমেয়াদি কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ভয়াবহ খাদ্যঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এটি এখন পেরু, ফিলিপাইন এবং কিউবা থেকে লেবানন ও তিউনিসিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেসব দেশের অজনপ্রিয় শাসকদের ক্ষমতাকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যে আজ যা ঘটছে, তার সঙ্গে বিশ্লেষকেরা আরব বসন্ত বিদ্রোহের তুলনা করছেন। মিসর (যে দেশের সরকার ২০১১ সালে উৎখাত হয়েছিল) বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক দেশ। দেশটির প্রায় সাত কোটি মানুষ রাষ্ট্রের দেওয়া ভর্তুকিযুক্ত রুটির ওপর নির্ভর করে। গত বছর মিসর যত গম আমদানি করেছিল, তার ৮০ শতাংশই ছিল রাশিয়া এবং ইউক্রেনের। এখন গমের যে উচ্চমূল্য এবং সরবরাহের ঘাটতি, তা যদি আরও খারাপের দিকে যায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল–সিসিকে তাঁর পূর্বসূরি হোসনি মোবারকের ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে।

ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করার মতো আরেকটি দেশ হলো ইরান। সরকার রুটি, রান্নার তেল এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বাড়ানোর পর গত সপ্তাহে দেশটির খুজেস্তানে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে ইরানিদের অবস্থা খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়েছে। সেখানকার খাদ্যপণ্যের দাম যদি নিম্নমুখী হতে থাকে, তাহলে ২০১৭-১৮ সালের দেশব্যাপী বিদ্রোহের মতো সেখানে আরও একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, দক্ষিণ মাদাগাস্কার এবং ইয়েমেনে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ভয়ানক রূপ নিয়েছে। সেখানে অনাহারজনিত মৃত্যুর পরিমাণ বাড়ছে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সাইমন টিসডাল পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার ও দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার বিদেশসংক্রান্ত সম্পাদক