সোই নেইং নামের এক আলোকচিত্র সাংবাদিক মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কারাগারে মারা গেছেন সম্প্রতি। গত ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর এই প্রথম সেখানে কোনো সাংবাদিক নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেলেন। ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মাসহ মিয়ানমারের নির্বাসিত মিডিয়া গ্রুপগুলোর দাবি, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে তিনি যখন জনগণের ‘নীরব প্রতিবাদের’ ছবি তুলছিলেন, তখন সেনাসদস্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যান।
একই সপ্তাহে সেনা কর্তৃপক্ষ শান প্রদেশে তিন সাংবাদিককে তিন বছর করে জেল দিয়েছে। গত ১০ মাসে মিয়ানমার সরকার শতাধিক সাংবাদিককে আটক করে। সম্প্রতি ফিলিপাইনে জোসেফ মালাবানান নামের আরেক সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের আমলে এ নিয়ে ২২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হলো।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তার শাসনামলে সাংবাদিক তথা ভিন্নমতাবলম্বীরা হত্যা-নির্যাতনের শিকার হবেন; তা অবধারিত। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার সাংবাদিকদের ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, তা-ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখছি। কিন্তু যেসব দেশ নিজেদের গণতান্ত্রিক (হোক তা ভঙ্গুর কিংবা হাইব্রিড) বলে দাবি করে, সেসব দেশেও সাংবাদিকেরা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। হুমকি ও হামলার শিকার হচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস–আরএসএফের প্রতিবেদনে অনুযায়ী চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৮৮ জন সাংবাদিক জেলে আছেন; যা ১৯৯৫ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। যখন সরকারগুলো হুমকি-ধমকি দিয়েও সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশে নিবৃত্ত করতে পারে না, তখনই তারা তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি অস্ত্র প্রয়োগ করে, জেল–জুলুমের আশ্রয় নেয়।
আরএসএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সারা বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা গত বছরের চেয়ে কমেছে, ৪৬ জন। মূলত মধ্যপ্রাচ্য স্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সংখ্যাটি কমেছে। এর আগে সেখানে যুদ্ধ-হানাহানি ও জঙ্গিদের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক বেশি সাংবাদিক খুন হয়েছেন।
বর্তমানে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক আটক আছেন চীনে। এর মধ্যে হংকংয়েই বেশি আটক হয়েছেন নিরাপত্তা আইনে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নিরাপত্তার নামে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এরপর ৫৩ জন আটক করে মিয়ানমার দ্বিতীয়, ভিয়েতনাম ৪৩ জন আটক করে তৃতীয়, বেলারুশ ৩২ জন আটক করে চতুর্থ ও সৌদি আরব ৩১ জন আটক করে পঞ্চম স্থানে আছে। ২০২১ সালে মেক্সিকোতে ৭, আফগানিস্তানে ৬, ইয়েমেনে ৪ ও ভারতে ৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ইন্ডিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট বলছে, অন্তত ২২৬ জন সাংবাদিক ২০২০ সালে নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন; যাঁদের মধ্যে ১২ জন নারী সাংবাদিক।
অন্যদিকে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) তথ্য বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০২১ সালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুন হয়েছেন। তবে আরও ৫৬০ জন মারা গেছেন, যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায় না। ২০১২ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ১০০ সাংবাদিক মারা যান; যাঁদের বেশির ভাগই সিরিয়া ও সোমালিয়ায় দায়িত্ব পালন করছিলেন।
২০২১ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক নিগ্রহের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা মে মাসে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছয় ঘণ্টা আটক রেখে হেনস্তা করা, তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালে প্রণীত সরকারি গোপনীয়তা বা অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ৬২ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুন হন। উদ্বেগের বিষয় হলো ১০টি খুনের মধ্যে ৯টিরই বিচার হয় না। অপরাধীরা শাস্তির বাইরে থেকে যায়। গত বছর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির অবসান দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, অনেক সাংবাদিক সংঘাত পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘাতের বাইরে খুনের ঘটনা বাড়ছে। অনেক দেশে দুর্নীতি, চোরাচালান, মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা পরিবেশ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়েও সাংবাদিকেরা খুন হচ্ছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেকোনো অপরাধ গোটা সমাজে প্রভাব ফেলে, কেননা এর মাধ্যমে অপরাধীরা জনগণকে তথ্য জানতে দিতে চাইছে না।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকালে কী দেখি? এখানে কি সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি, জেল–জুলুমের ঘটনা কমেছে? সাংবাদিকেরা কি নির্বিঘ্নে তথ্য সংগ্রহ করে জনগণের কাছে তা পৌঁছাতে পারছেন? এর সোজা উত্তর পারছেন না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১২৯টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আলোচ্য সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৮ জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা যান বুরহান মুজাক্কির (২৫)। আওয়ামী লীগের এক পক্ষ তাঁকে নিজেদের অনুসারী বলে দাবি করেছে। সেই ঘটনায় মামলা হলেও তার অগ্রগতি নেই। সাংবাদিকদের ওপর যত হুমকি ও হামলা বাড়ে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা তত সংকুচিত হয়। জীবন রক্ষা করতে তাঁরা অনেক জানা তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
আরএসএফের প্রতিবেদনমতে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫২তম অবস্থানে। গত বছর ছিল ১৫১তম স্থানে। অন্যদিকে পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪২ ও ১২৭। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সবার নিচে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, এ তথ্য আমাদের গৌরব বাড়ায় না; বরং লজ্জিত করে। স্বাধীনতা কেবল গণমাধ্যমের সংখ্যা দিয়ে বিচার হয় না, বিচার হয় সাংবাদিকতার মান ও অভয় পরিবেশ দিয়ে।
আরএসএফ জানিয়েছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সাংবাদিকতা করতে হয়। এতে আরও জানানো হয়, বিশ্বের ৭৩টি দেশে সাংবাদিকতা পুরোপুরি অথবা ভয়াবহভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার। এ ছাড়া ৫৯টি দেশে রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে অনেক দেশের সরকার সাংবাদিকতার ওপর দমন-পীড়নের মাত্রাও বাড়িয়েছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক নিগ্রহের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা মে মাসে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছয় ঘণ্টা আটক রেখে হেনস্তা করা, তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালে প্রণীত সরকারি গোপনীয়তা বা অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আর এ আইনের কার্যকারিতা নেই। ব্রিটিশ সরকার আইনটি করেছিল এদেশীয় আমলাদের বিরুদ্ধে কথিত গুপ্তচরবৃত্তি রোধে।
স্বাধীন বাংলাদেশে সেই আইনই ব্যবহার করা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। পরে রোজিনা ইসলাম জামিনে মুক্তি পান। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থা ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে ‘ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড-২০২১’ দেয়। তিনি নিজে সে পুরস্কার নিতে সেখানে যেতে পারেননি পাসপোর্ট হাতে না থাকায়। এখনো তঁার ওপর মামলার খড়্গ ঝুলছে।
এরপরও যদি সরকার দাবি করে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা নির্ভয়ে লিখতে পারছেন, তাঁদের কোনো হুমকি ও হামলার শিকার হতে হচ্ছে না; সেটি সত্যের অপলাপই বটে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com