‘মা-বাবার ডিভোর্স হলে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, ছেলেমেয়েদের মিডলম্যানগিরি করা। মায়ের কথা বাবাকে এবং বাবার কথা মাকে গিয়ে বলতে হয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর মন্তব্যে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছিল। বছর কয়েক আগে মা-বাবার বিচ্ছেদের সময় তাঁকে এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁর মতো শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের কথা ভাবছিলাম ‘করোনার দুই বছরে সখীপুরে বিয়ে ও বিচ্ছেদ দুই-ই বেড়েছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন পড়ে (প্রথম আলো, ২২ মার্চ ২০২২)। জানা যায়, গত দুই বছরে সখীপুর উপজেলায় ১ হাজার ৫৯০টি বিয়ে হয়েছে আর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ১ হাজার ৫৪টি। ২০১৮-১৯ সালে যেখানে মোট বিয়ে হয় ১ হাজার ৩৪৪টি, আর বিচ্ছেদ হয় ১ হাজার ৮৬টি।
গত বছরের মাঝামাঝিতে গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। শহর ও গ্রাম দুই জায়গাতেই বিচ্ছেদ বেড়েছে। তবে গ্রামের তুলনায় শহরে বিচ্ছেদের হার বেশি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ১ হাজার ১৪১টি। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২। এ হিসাবে ২০২১ সালে প্রতি মাসে বেড়েছে ৯৯টি বিচ্ছেদ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নারীরাই বেশি বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। এ হার ৭৫ শতাংশ।
গবেষকদের মতে, করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক চাপের কারণে সৃষ্ট পারিবারিক কলহই বিচ্ছেদের বড় কারণ। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে পারস্পরিক বোঝাপড়া না হওয়া থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন, নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রভাব ইত্যাদি রয়েছে। এসবের বিশ্লেষণে যাব না। বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাবে শিশুরা যাতে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই।
মা-বাবার বিচ্ছেদের প্রভাব শিশুদের জীবনে নানাভাবে পড়তে পারে। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যাভ্যাস, আচরণ ও পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে পরিবর্তন। সন্তানেরা হতাশা ও উদ্বেগ বোধ করতে পারে। অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আশঙ্কাও আছে।
বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে বেশির ভাগ গবেষণায় জানা যায়, প্রথম ১-৩ বছর শিশুদের একটু বেশি অসুবিধা হয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে। এ ছাড়া সব শিশু মা-বাবার বিচ্ছেদে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যারা মা-বাবার মধ্যে খুব বেশি মাত্রার দ্বন্দ্ব ও তিক্ততা দেখেছে, তারা বিচ্ছেদে একধরনের স্বস্তি পায়। আমার এক সুইডিশ বন্ধুর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। সে বলেছিল, ‘আমার সাত-আট বছর থেকেই মা-বাবার খারাপ সম্পর্ক দেখেছি। বয়স একটু বাড়লে আমি নিজেই তাঁদের আলাদা হয়ে যেতে বলেছি। আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় তাঁদের কলহের কারণে বাসায় থাকার মতো পরিবেশ ছিল না। সোশ্যাল ওয়ার্কার আমাকে অন্য এক পরিবারে রাখার ব্যবস্থা করেন। তাই শেষমেশ মা-বাবার যখন ডিভোর্স হয়, তখন আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে ছিলাম।’
বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদকে এখনো সমাজের অনেকেই নিন্দনীয় মনে করে। তাই মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে শিশুরা একটা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। অনেকে বিদ্যালয়ে বুলিংয়ের শিকার হয় এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের কটু মন্তব্য শোনে। এই বৈষম্যমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
মা-বাবার বিচ্ছেদের পর দুজনের সঙ্গেই আমার বন্ধুটির সুন্দর সম্পর্ক ছিল। সে নিজে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দুই সন্তানের বাবা। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে, যেখানে মা-বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তান পড়াশোনা ও কর্মজীবনে সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের কেউ কেউ আমার সুইডিশ বন্ধুর মতো ভাবে। কারণ, মা-বাবার মধ্যে তীব্র কলহ ও বিদ্বেষ তাদের কাছে ছিল অসহনীয়। অনেকেই মা-বাবার সম্পর্কে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন দেখেছে। শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা যদি তাদের সামনে নির্যাতন ঘটতে দেখে, তাহলে সেটাও একধরনের শিশু নির্যাতন। এ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদকে এখনো সমাজের অনেকেই নিন্দনীয় মনে করে। তাই মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে শিশুরা একটা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। অনেকে বিদ্যালয়ে বুলিংয়ের শিকার হয় এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের কটু মন্তব্য শোনে। এই বৈষম্যমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
বিবাহবিচ্ছেদ-পরবর্তী জটিলতা অনেক ক্ষেত্রেই খুব তিক্ত হয়ে পড়ে। সন্তান কার কাছে থাকবে, এটা নিয়ে মা-বাবার মধ্যে লড়াই দেখা যায়। আদালতের শরণাপন্ন হলে একটি রায় পাওয়া যায়। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ায় যে টানাপোড়েন চলে, তাতে ওই সন্তানের ওপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেউ কেউ ভরণপোষণ, সম্পত্তির ভাগাভাগিসহ নানা বিষয়ের আলোচনায় সন্তানদের জড়িয়ে ফেলেন বা তাদের নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করেন। যখন মা-বাবা সন্তানদের সামনে ঝগড়া বা পরস্পরকে দোষারোপ করেন, তখন সন্তান ভাবে যে তাকে যেকোনো একজনের পক্ষ নিতে হবে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর। মা-বাবার দায়িত্ব যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু বিচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে অনেকেই তা করতে ব্যর্থ হন। নিজেদের রাগ ও হতাশা সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের আচরণে প্রকাশ পায়।
মা-বাবাকে সন্তানের দৃষ্টি দিয়ে পরিস্থিতিটা বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবার সান্নিধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু তা নিশ্চিত করা না গেলে এবং বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠলে সন্তানকে বিচ্ছেদের ব্যাপারটি যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলা দরকার। সন্তানেরা যদি বিচ্ছেদ নিয়ে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে, তাহলে তা মনোযোগ দিয়ে মা-বাবাকে শুনতে হবে। প্রতিটি শিশুই আলাদা। বিচ্ছেদে তাদের প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হবে। তাদের জানাতে হবে, উদ্বেগ, রাগ, দুঃখ ইত্যাদি সব অনুভূতিই স্বাভাবিক।
বিচ্ছেদের পরের তিক্ততায় সন্তানকে না জড়ানো মা-বাবার দায়িত্ব। বিচ্ছেদ হলেও মা-বাবা দুজনেই যে সন্তানকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসবেন, শিশুদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে হবে। সন্তানকেও জানাতে হবে, মা-বাবার সম্পর্কে পরিবর্তন হলেও সে দুজনকেই ভালোবাসতে পারবে।
বিবাহবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সংবেদনশীল আচরণ করা প্রয়োজন। তাহলে এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা তাঁদের জন্য তুলনামূলক সহজ হবে। মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের কারণে কোনো শিক্ষার্থী যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, তা শিক্ষকেরা নিশ্চিত করবেন।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী