এবারের নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতির কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন বা শিফট দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি হয়তো অনেকেরই নজরে এসেছে। প্রথম আলোয় সংবাদ ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি হলো, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থানগত পরিবর্তন আমরা লক্ষ করছি। মধ্যডানপন্থী ও অপেক্ষাকৃত উদার বলে দাবি করা আওয়ামী লীগ ক্রমেই কট্টরপন্থী ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। আবার মধ্যডানপন্থী ও মডারেট ইসলামপন্থী বলে চিহ্নিত করা বিএনপি অপেক্ষাকৃত উদার ও ধর্মনিরপেক্ষদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের ধর্মাশ্রিত দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগ তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে। কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিগুলোকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ডিগ্রির সঙ্গে সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে। আওয়ামী লীগের এই কৌশলের সবচেয়ে বড় চমক ছিল ভিন্ন নামে সংবর্ধনার আড়ালে হেফাজতে ইসলামের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি। এটা আওয়ামী লীগের কৌশলের সাফল্য। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের তিক্ততার সূচনা হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব পরিচালনার অভিযোগ করেছিল আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা, সেই পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আল্লামা শফী একই মঞ্চে বসেছেন। নিঃসন্দেহে এটা খুবই বড় ঘটনা। ৫ মে ঘটনার পর হেফাজতের অনেক নেতাকেই পুলিশ আটক করে। রিমান্ডে নিয়েও হেফাজতের অনেক নেতা–কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হেফাজতের পক্ষ থেকেও হতাহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এখন এসব বিষয়ে দুই পক্ষই চুপ। এ ছাড়া মুফতি আমিনীর ছেলে হাসনাত আমিনীকেও পুলিশ আটক করেছিল অনেক আগে। সম্ভবত পুলিশ হাসনাত আমিনীকে আটকের কথা প্রথমে স্বীকার করেনি। মুফতি আমিনীকেও প্রকারান্তরে লালবাগ মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন একপ্রকার নজরবন্দী বা গৃহবন্দীই করেই রাখা হয়। এই অবস্থাতেই মুফতি আমিনী মারা যান। শোনা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বাবার আসনে মাওলানা হাসনাত আমিনী মহাজোটের প্রার্থী হতে পারেন। ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নয়া সখ্য অনেকের পছন্দ হতে পারে। আবার অনেকে পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগের কৌশল যে সফল হয়েছে, তা বলতে হবে।
বলা যায়, এখন দেশের নিবন্ধিত অধিকাংশ ইসলামি দলই আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে রয়েছে। প্রথম আলোয় ২০ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনে ৭০টি নিবন্ধিত ইসলামি দল রয়েছে। এর মত্যে ৬৩টি দলই মহাজোটের সঙ্গে যুক্ত। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোটে আছে মাত্র পাঁচটি।
মজার বিষয় হচ্ছে, ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে শুধু আওয়ামী লীগের দূরত্ব ঘোচেনি। মহাজোটে থাকা বামমনা দলগুলোর দূরত্ব কমেছে অনেকটাই। মহাজোটের অন্যতম শরিক দল ওয়ার্কার্স পাটি ও জাসদের নেতারাও এখন বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। এমন নয় যে জাসদ বা ওয়ার্কার্স পাটি ইসলাম বা ধর্মবিরোধী দল। তবে বরাবরই বাংলাদেশে বামপন্থী দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে কট্টর ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী ভোটের কারণে কট্টর ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে কেবল আওয়ামী লীগই নয়, বেশ কিছু বামমনা দলেরও নৈকট্য বাড়ছে।
আওয়ামী লীগ ও ও কিছু বামমনা দলের সঙ্গে বিএনপির অবস্থানেরও পরিবর্তন হচ্ছে। বরাবরই কট্টর ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য বজায় রাখা বিএনপি এখন উদার ও ধর্মনিরপেক্ষদের সঙ্গে জোট গড়ছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকেই বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতিতে সব সময় ঘোষিতভাবেই ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোট করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন কট্টর ইসলামপন্থী দলের নেতারা সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীও হয়েছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে। কিন্তু এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তার দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বিএনপির সঙ্গে থাকা অধিকাংশ ইসলামপন্থী দলই আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলে গিয়েছে। বিএনপিও তার অবস্থান থেকে সরে এসে বা ইসলামপন্থীদের হারিয়ে উদারপন্থী বলে পরিচিত বিভিন্ন দলের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা বা বাম ঘরানার। তাই ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশগুলোয় একই মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়েছে। ওই সব সমাবেশে যেমন ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে ভাষণ শেষ হয়েছে, আবার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলেও শেষ হয়েছে।
বিএনপিও একদিকে উদারপন্থীদের সঙ্গে নির্বাচনী মিত্রতা সৃষ্টি করেছে, আবার ২০–দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও আছে। এসব জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কারণে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির দিগন্তরেখায় একধরনের অবস্থানগত পরিবর্তন হচ্ছে। এখনই এটা বলা দুরূহ যে আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারাচ্ছে। তবে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতা মধ্যবাম অবস্থান থেকে ডানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে দলটিকে। এই একই কারণে বিএনপিও একসময় মধ্যডানপন্থী বলেই বিবেচিত হতো।
দেশের প্রধান দুটি দলের এই অবস্থানগত পরিবর্তন বা নীতিগত শিফটের কারণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনছে বিএনপির ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাতে। আওয়ামী লীগ ইসলামের বিরোধী বা ইসলামবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করবে না—এটা স্থাপন করবে। কারণ, বিএনপি শিবির থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সব সময়ই প্রচারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে ইসলাম থাকবে না। আবার বিপরীতে বিএনপিরও অবস্থানগত পরিবর্তন কট্টর ইসলামপন্থীদের মিত্র বা বন্ধুর পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসে একটি উদার পরিচিত স্থাপন করা। অনেকেই মনে করেন, ইসলামপন্থী দলের সদস্যদের বেশির ভাগই বিএনপিকে ভোট দিয়ে থাকেন। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী শিবির থেকেও বিএনপিকে সব সময় কট্টর ইসলামপন্থী বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
অনেকেই বলতে পারেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির অবস্থানগত পরিবর্তন কেবলই নির্বাচনী কৌশলগত জোট। কিন্তু যতই নির্বাচনী জোট হোক, রাজনৈতিক কাঠামোতে এর কিছু না কিছু প্রভাব থাকবেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ৯০ শতাংশই এই দুই দলের দখলে। এর আগে বিএনপি নির্বাচনী জোট গড়তে গিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের ও কট্টর ইসলামপন্থীদের মিত্র হিসেবে দেশে–বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মিত্রতা আওয়ামী লীগের জন্য ভোটের রাজনীতিতে কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা এখনই বলা সম্ভব না। নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের অবস্থান যে ক্রমে কট্টর ডানপন্থার দিকে সরে যাচ্ছে, এটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—এই দুই দল কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি করেনি। দুই দল সরাসরিই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছে। নির্বাচনী স্লোগান বা পোস্টারে ধর্মের ব্যবহার দেখেছি। বিএনপি হয়তো সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপির সেই ছেড়ে আসা ঘরেই ঢুকতে চাইছে।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন