ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দুই মাস হলো। এখনো থামেনি প্রতিবাদ। তবে কিছুটা থমকেছে। এই প্রতিবাদ একই সঙ্গে নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধেও।
কিন্তু এর শেষ কোথায়? এর ভবিষ্যৎ কী? এই প্রতিবাদ কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে? না পারলে পরিণতি কী হবে তার? সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী ছাড়িয়ে এসব প্রশ্ন ভাবাচ্ছে ভারত সীমান্তের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের মানুষকেও।
অনেক অর্জন, অনেক দুর্বলতা
বিশ্বজুড়ে মনোযোগ পাওয়া এই আন্দোলনের প্রধান দিক তার অহিংস চরিত্র। প্রায় ৫০টি বড় জমায়েত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতা ছাড়াই দেশটির সব প্রান্তে ছড়িয়েছে প্রতিবাদের এই ঢেউ। আন্দোলনকারীরা নিজস্ব শ্রেণি-পেশার কোনো বিষয়ে নয়, দেশের জন্য নীতিগত বিষয়ে কথা বলছে। সবই হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নিজ নিজ খরচে। সমকালীন দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য নজির এটা। বিশ্বের ‘বৃহৎ গণতন্ত্র’-এর ‘সেক্যুলার’ রাজনৈতিক আবহে সংখ্যালঘুরা কতটা দুঃসহ অবস্থায় আছে, সেটাও জানাল এই আন্দোলন। একই আন্দোলন এ–ও দেখাল, সংখ্যালঘুদের জন্য সংখ্যাগুরুরা অনেকে রাস্তায় মার খাওয়ার ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। এ রকম দৃশ্য সংখ্যালঘুদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নামতে উৎসাহিত করেছে। এই আন্দোলন গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের অনন্য এক মঞ্চ হিসেবে তৈরি করতে পেরেছে নিজেকে। ধর্ম ও রাজনীতির সর্বগ্রাসী মিশ্রণের যুগে সেক্যুলারিজম তরুণদের এতটা আকৃষ্ট করতে পারবে, এটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করেছে। আন্দোলনকারীদের গায়ের রং, পোশাক, বর্ণ ও ধর্মবিশ্বাসের বৈচিত্র্যও এর আরেকটা শক্তির দিক। এতে নেতৃত্বের কোনো কর্তৃত্ববাদী কাঠামোও ছিল না এবং এখনো নেই। এ রকম আরও অনেক অর্জন আছে এই আন্দোলনের। পাশাপাশি এ–ও মনে রাখা দরকার আন্দোলনের প্রতিপক্ষ আরএসএস পরিবার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক গোত্রের একটি তারা। এই আন্দোলনকে পরাস্ত করতে, এর শেষ দেখতে আরএসএস সবকিছুই করছে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু স্থানে আন্দোলনে ফাটল ধরানো গেছে। তরুণদের কাউকে কাউকে ‘দেশবিরোধী শক্তি’ হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
আন্দোলনের কৌশলগত একটা ভুল, প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রার্থনায় লিপ্ত হতে দেওয়া। ভারতের মুসলমান তারুণ্য বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনে শামিল ছিল এবং আছে। কিন্তু সেক্যুলার সংগঠকেরা অনেক সময় অতি উৎসাহের পরিচয় দিয়েছেন। সংখ্যাগুরু তোষণ যেমন গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি সংখ্যালঘু তোষণ গণতন্ত্রের সংগ্রামের আয়তন কমায়। ‘সিএএ-এনআরসি’বিরোধী সমাবেশগুলোতে নামাজের দৃশ্য আন্দোলনকে সংখ্যালঘুদের আন্দোলন হিসেবে দেখানোর কাজে বিজেপিকে সাহায্য করেছে। সমাবেশগুলোকে ‘সংখ্যালঘুর মর্যাদা রক্ষা’র আন্দোলন প্রমাণ করার চেয়েও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখানো বেশি জরুরি ছিল।
আন্দোলন হচ্ছে শহুরে মধ্যবিত্তের চৌহদ্দিতে
আন্দোলনের সংগীতময় মিছিলগুলো শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে যতটা আবেদনময়—গ্রামীণ ভারতের দরিদ্র মানুষের জন্য ততটা নয়। ভারত রাষ্ট্র সেক্যুলার থাকা না-থাকায় মুসলমানদের স্বার্থ আছে। কিন্তু কোটি কোটি দরিদ্র ভারতবাসী হিন্দুর চোখে তার দৃশ্যমান আবেদন কম। নতুন করে ‘অবৈধ মুসলমান’দের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ার মতো কিছু ঘটেনি তাদের জীবনে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনগুলো এ রকম মানুষদের কাছে সামান্যই অন্যায্য মনে হচ্ছে। কারণ, ছাত্র-তরুণেরা কেউ তাদের কাছে যায়নি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে। এ রকম অবস্থায় চলতি আন্দোলনকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে এবং শহুরে চৌহদ্দির বাইরে নিতে মাটি ও মানুষের আরও স্বার্থ যুক্ত করতে হবে এতে। অন্তত বেকারি ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিপর্যয়কে আন্দোলনের দাবিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কৃষক ও শ্রমিকেরা যদি সরাসরি তাদের স্বার্থ এই আন্দোলনে খুঁজে না পায়, ‘আজাদি’র স্লোগানের প্রতি ইতিমধ্যে সৃষ্ট মনোযোগ দ্রুতই হারিয়ে ফেলবে তারা। আন্দোলনের ‘শেষ লক্ষ্য’ সম্পর্কে বুঝতে চাইছে নিচুতলার মানুষ এবং সেখানে রুটি-রুজির কোনো স্বার্থ আছে কি না, সেটাও দেখতে ইচ্ছুক। বিশ্বের সেসব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সম্প্রতি সফল হয়েছে, যেগুলো কৃষক-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে।
মোদি সরকারের সমর্থক ভিত্তি থেকে দরিদ্র হিন্দুদের বের করে আনাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ প্রতিবাদকারীদের সামনে। আপাতত সেটা ঘটেনি। ১৭টি ভারতীয় রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। তাদের সমর্থক গোষ্ঠীতে বড় কোনো ধসের আলামত দেখা যায়নি। দরিদ্র উত্তর প্রদেশে যেসব ঝাঁজালো বিক্ষোভ হয়েছে তার মূলশক্তি ছিল সংখ্যালঘু তরুণেরাই।
স্বতঃস্ফূর্ততাকে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে রূপ দিতে নেতৃত্ব দরকার
শহুরে তরুণদের এই আন্দোলন নিজেকে অতিমাত্রায় সংবিধানবাদী দেখাতেও তৎপর। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনকে সংবিধানবিরোধী দেখিয়ে উচ্চ আদালতের সহানুভূতি পেতেই এই কৌশল। আন্দোলনকারীরা হয়তো ভেবেছিলেন ‘সংবিধান রক্ষা’র আওয়াজ কিছু বিজেপি সমর্থককেও তাদের মিছিলে শামিল করবে। কিন্তু অন্ধ সংবিধানবাদ এ–ও দেখায়, জনস্বার্থে তাতে পরিবর্তন-সংশোধন করা যাবে না। সংবিধানকে চির অপরিবর্তনীয় ধর্মগ্রন্থে পরিণত করছে ভারতীয় এই আন্দোলন। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্বিকার মূর্তি আন্দোলনের সংবিধানবাদিতার কৌশলকে অসফল প্রমাণ করছে।
বহু সংস্কৃতির ভারতে বহুত্ববাদের স্বার্থেই এই আন্দোলনকে সংবিধানবাদিতার কাঠামো থেকে বের করা জরুরি। সে জন্য দরকার সাহসী নেতৃত্ব। নেতৃত্বহীনতা এত দিন এই প্রতিবাদযাত্রার শক্তির দিক ছিল। নেতা না থাকায় মোদি সরকার কাউকে চট করে আটক করে আন্দোলন থামাতে পারেনি। বিজেপির কর্মীরাও চরিত্রহননের জন্য দল বেঁধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। কিন্তু গত দুই মাসের প্রতিবাদকে এখন রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করার সময় এসেছে। যার জন্য প্রয়োজন আন্দোলনের ভেতর থেকে আসা শক্তিশালী নেতৃত্ব কাঠামো। প্রতিদিন সময় দেওয়ার মতো হাজার হাজার কর্মীও দরকার এই সংগ্রামকে সফল করতে।
আরএসএস-বিজেপি এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষায় ছিল। তারা জানে, হাজার হাজার মাইলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানা বর্ণ, জাত, ধর্ম ও আদর্শের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে এক সুতায় গাঁথার মতো গ্রহণযোগ্য ছাত্রনেতা দুর্লভ।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৫-৭৭ সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জন আন্দোলনের কথা। মোরারজি দেশাই ও জয়প্রকাশের মতো সংগঠক পেয়েছিল ওই আন্দোলন। চলতি আন্দোলন তেমন কাউকে পায়নি। আজকে কানাহিয়া কুমার বা চন্দ্রশেখর আজাদের মতো নেতারা সেটা পারবেন কি না বা করবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়। চলতি আন্দোলনে এককভাবে এই দুজনই বেশি আবেদন ও মনোযোগ টানছেন।
এটা সত্য নয় যে একক দাবিনির্ভর আন্দোলন সরকার হটাতে পারে না। কংগ্রেসের মনোমোহন সিংহ সরকারের মূল সর্বনাশ হয় আন্না হাজারেদের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন যতটা অর্থনৈতিক চরিত্রের এনআরসি-সিএএবিরোধী আন্দোলন তেমন নয়।
সেক্যুলার রাজনীতি নিঃশেষের ঝুঁকি
চলতি আন্দোলনের প্রতি বিদ্যমান বিরোধী দলসমূহের সমর্থনেরও ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যালঘু হয়েও সিএএ পাস করাতে পেরেছে। জাতীয় কংগ্রেস ছাত্র-তরুণদের সমর্থনে সব দলের যে বৈঠক ডেকেছিল তাতে মায়বতীর বহুজন সমাজবাদী দল ও মমতার তৃণমূল কংগ্রেস যোগ দেয়নি। যায়নি আম-আদমি পার্টিও। তবে তৃণমূল স্বতন্ত্রভাবে এই আন্দোলনের পক্ষে সবচেয়ে সরব রাজনৈতিক দল।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ছাত্র শাখা আন্দোলনে থাকলেও দলের মূল নেতা রাহুল গান্ধী টুইটারের বাইরে আন্দোলনে সামান্যই সক্রিয়। তাঁর ভগ্নি প্রিয়াঙ্কা একদিন রাস্তার প্রতিবাদে শামিল হন কিছু সময়ের জন্য। কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে যেভাবে সমালোচনামুখর কংগ্রেসের হাতে থাকা সাত রাজ্যের মাত্র দুটির (পাঞ্জাব ও রাজস্থান) বিধানসভায় তেমন দেখা গেছে। কংগ্রেস এই আন্দোলনে পুরো শক্তি দিয়ে নিজের মুসলমানবান্ধব ইমেজ তৈরি করতে চাইছে না।
অন্য দলগুলোর মধ্যে শিবসেনা, আসাম গণপরিষদ, বিজু জনতা দল নিজ নিজ রাজ্যে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মৃদুস্বরে বললেও লোকসভায় তার পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। চলতি গণপ্রতিবাদে জনবল শামিল করে একে আরও সামনে এগিয়ে নিতে অনিচ্ছুক তারা। কোনো দলই ‘মুসলমান সমর্থক’ ইমেজ গড়তে চায় না। তারা নিশ্চিত নয়, ছাত্র বিক্ষোভ বিজেপির তৈরি আইন বদলাতে বা থামাতে পারবে। দক্ষিণ ভারতের দলগুলোও একই বিবেচনায় নীরব। কেবল বামেরা সীমিত শক্তির পুরোটা দিয়ে আন্দোলনকারীদের সমর্থনে আছে। কিন্তু সব মিলে ছাত্র-তরুণদের প্রতিবাদকে সাংগঠনিক ছায়া দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার মতো অভিভাবকত্বের ঘাটতি থাকছেই।
চলমান আন্দোলনের ব্যর্থতা মানেই মোদি ও অমিত শাহর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। ব্যর্থ আন্দোলন মধ্যপন্থী হিন্দুদেরও এই জুটির পেছনে শামিল করবে। যার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে সেক্যুলার রাজনীতি নিঃশেষ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও তা হতাশা ও বিপদের আবহ তৈরি করবে। ছাত্র-তরুণদের আজকের প্রতিবাদ তখন পরাজিত এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসের সামান্য ফুটনোট হয়েই থাকবে কেবল।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক