এবারের ঈদের দিনে সারা দেশে মোট দুর্ঘটনার শতকরা ৩৩ ভাগই ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ২০১৭ সালেও ঈদে মোট দুর্ঘটনার সাড়ে ১৫ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এক বছরের ব্যবধানে এক লাফে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বলা বাহুল্য, সব কটিই ছিল মারাত্মক। অর্থাৎ কারও না কারও মৃত্যু হয়েছে এসব ঘটনায়। এবার ঈদের আগে-পরের তিন দিন মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোট ৬২ জন। এর মধ্যে ২৯ জন নিহত হন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। ঈদের দুর্ঘটনার সব পরিসংখ্যান এখনো একত্র হয়নি। তারপরও প্রাথমিক তথ্য থেকে মনে হচ্ছে, এবারে দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা গত দু-তিন বছরের হিসাব ছাড়িয়ে যাবে।
করোনার কারণে গণপরিবহন এড়িয়ে অনেকেই বেছে নিয়েছিলেন মোটরসাইকেল। করোনার আগের বছরগুলোয় ঈদের ছুটিতে সড়কে মৃত মানুষের সংখ্যা কোনো বছরেই ৪০০ থেকে ৫০০-এর নিচে ছিল না। ২০১৬ সালে দুই ঈদে ঝরে পড়ে ৪০১টি প্রাণ—ঈদুল ফিতরে ১৯০ আর ঈদুল আজহায় ২১১। ২০১৭ সালের দুই ঈদে প্রাণ হারান ৫৬৪ জন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪০৫ ও ৫২৭। এসব মৃত্যুর সবটাই ঘটেছে প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনায়। মনে রাখতে হবে, এসব কেবল বড় দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর খবর। মৃত্যুর খবরের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলো নথিভুক্ত হয় না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। ঈদের দিন প্রথম ছয় ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিশোরের সংখ্যা ছিল ২৭। আরও চারটা জেলা শহরের তথ্য প্রায় একই রকম ছিল। এবার এমন কোনো জেলা পাওয়া যায়নি, যেখানে ঈদের তিন দিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কোনো কিশোর বা তরুণের মৃত্যু হয়নি।
মোটরসাইকেলের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে হু হু করে
বছর তিনেক আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) জানিয়েছিল, সে বছর ঢাকায় নিবন্ধিত হওয়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৬। অথচ ২০১৩ সালে রাজধানীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৩৩১। সে সময় সারা দেশে নিবন্ধিত হওয়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার ৮৬৭। অবশ্য ঢাকার বাইরে অনেকেই নানা কারণে নিবন্ধনের ঝুটঝামেলায় না যাওয়ায় প্রকৃত চালু মোটরসাইকেলের সঠিক সংখ্যাটা কারও জানা নেই।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সেদিন টেলিভিশনে বলেন, রাজধানীতেই নাকি এখন ৩০ লাখ মোটরসাইকেল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী (৩০ জানুয়ারি, ২০২০), ২০১৮ ও ২০১৯ এই দুই বছরে নতুন মোটরসাইকেল বিক্রির সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। মেরামতি, সেকেন্ডহ্যান্ড, গলাকাটা, ইত্যাদি এসব হিসাবের বাইরে। মজার ব্যাপার, বাংলাদেশে আলু-পটোল, পেঁয়াজ-মরিচ, গরু-খাসি-ব্রয়লারের দাম বাড়লেও কমেছে মোটরসাইকেলের দাম। উৎপাদনের শর্ত যুক্ত করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। ফলে, কোম্পানিগুলো বাজারে মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ পায়। পরের তিন বছর তরতর করে বাজার বাড়তে থাকে। বাজার আরও বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা এখন দাবি তুলছেন, মোটরসাইকেল কিনতে ব্যাংকঋণের সুযোগ দিতে হবে। বলছেন লাইসেন্সের শর্ত ঠিক আছে, কিন্তু আমরা চালানো শিখিয়ে লাইসেন্স দিলে ক্ষতি কী? চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দিতে বেসরকারি খাতকে সুযোগ দেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা। বাজারের চাঙা ভাব ধরে রাখতে থাইল্যান্ডের বড় কোম্পানিগুলো সরকারের পক্ষে নিজেরাই নাকি লাইসেন্স দেয়। থাইল্যান্ডে অবশ্য অনেক কিছুই হয়। যার যেটা পছন্দ, সে সেটার পক্ষে ওকালতি করবেই।
মোটরসাইকেল ও দুর্ঘটনা
মোটরসাইকেল বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, ‘গাড়ির ভেতরে আপনি যেমন চারদিক থেকে একটা নিরাপত্তাবলয়ে থাকেন, কিন্তু মোটরসাইকেলের চারদিক থাকে খোলা। দুই চাকার ওপর ভারসাম্য গাড়ির মতো এত ভালো থাকে না। এ কারণে আরোহীদের পাশাপাশি পথচারীরাও দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকেন।’
বাংলাদেশের বাজারে যেসব হেলমেট মেলে, সেগুলোর মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। ট্রাফিক আইনে এখন চালকের পাশাপাশি সহযাত্রীরও হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। হেলমেট না থাকলে পাম্পগুলো এখন তেল বেচে না। তবে হেলমেটের মতো মাথায় একটা কিছু থাকলেই চলে। হালকা-পলকা উপাদানে তৈরি ওই সব ঠুনকো হেলমেটে সুরক্ষা দূরে থাক বরং ক্ষতি হয় আরও বেশি। মজবুত উপাদানে তৈরি হেলমেট, যা মাথাকে পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি কান ও থুতনি রক্ষা করবে, এমন শিরস্ত্রাণ বা হেলমেট খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে মনঃসামাজিক বিজ্ঞানীরা অন্য কিছু কারণ নির্ণয় করেছেন। তাঁদের মতে, বন্ধুদের চাপ (পিয়ার প্রেশার), সাবালকত্ব অর্জনের মাপক, কম বয়সের উচ্ছ্বাস, অ্যাডভেঞ্চারিজম, জীবনে প্রথম স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালানোর উত্তেজনা, প্রতিযোগিতার মনোভাব, হাত ঘুরালেই যত খুশি গতি বাড়ানোর সুযোগ ইত্যাদি কারণে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা হয় বেশি।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমানোর উপায় আছে কি
মিয়ানমার সরকার সব বড় শহরে, বিশেষ করে ইয়াঙ্গুনে মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে অনেক বছর আগে। এ দেশে সেটা কেউ আশা করে না। তবে নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে চালকের পারদর্শিতা পরীক্ষাকে হেলাফেলা করা যাবে না। পারদর্শিতার তালিকায় মানসিক সক্ষমতাকেও আমলে নিতে হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক যোগ্যতা নিয়েও ভাবতে হবে। ২০ থেকে ২৫ বছরের সব তরুণের একই ধরনের শারীরিক ও মানসিক শক্তি নাও থাকতে পারে।
মোটরসাইকেলের দাম কমে যাওয়ায় উচ্চ ক্ষমতার মোটরসাইকেলের প্রতি তরুণদের ঝোঁক বেড়ে গেছে। এ বছর ১৫০ বা তার চেয়ে বেশি সিসির মোটরসাইকেলে বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ। (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০২০)। এখানে একটা লাগাম টানা দরকার। মোটরসাইকেল বিক্রির আগেই তার গতিসীমা নিয়ন্ত্রিত করে দেওয়া উচিত। হেলমেটের গুণগত মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক।
nayeem5508@gmail.com