সমীরের মা মাটির চুলায় রাঁধতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কিন্তু সমীর চাইল, পাশের বাড়ির মেম্বার চাচির মতো তার মা–ও শহুরে আমেজে সিলিন্ডারের চুলায় রান্নাবান্না করুক। মিস্ত্রি এনে সব সেট করা হলো। কিন্তু ছয় মাস না যেতে দুর্ঘটনা ঘটল। দগ্ধ হলো সমীরের বোন, তার মা ও এক প্রতিবেশী। সমীরের মা তিন দিনের মাথায় মারা গেলেন। বোন ও তার প্রতিবেশীকে প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলো।
দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসার ফলে সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের অনেক বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস–সংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেরও আয় বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার এখন খড়ি–লাকড়ির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডারের গ্যাস। এটা দেশের অগ্রগতির লক্ষণ। তবে সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যে ঝুঁকি আছে এবং সেই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য যে সচেতনতা প্রয়োজন, আমাদের দেশে তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষ মারা যাচ্ছে, গুরুতরভাবে জখম হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে।
শুধু সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটি থেকে বিস্ফোরণ ঘটেও দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় এবং এর আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে অনেক গ্যাসপাইপ সংযোগ নেওয়া হয়েছে; অনেক গ্যাস পাইপলাইনে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে; পাইপলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মানুষের হতাহত হওয়ার খবর মাঝেমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পাইপলাইনের লিকেজ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন একই পরিবারের নয়জন। পাইপলাইনের বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ, চুলার ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ইত্যাদি নানাভাবে দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গোচরে এসেছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বুধবারের ঘটনাসহ চলতি বছর এ পর্যন্ত গ্যাস–দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি। গত বছরের চেয়ে শতাধিক বেশি: গত বছর ঘটেছিল ৭৯টি। ২০১৬ সালে ১৩১টি এবং ২০১৫ সালে ৮০টি গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দিনে দিনে তা বেড়ে চলেছে। দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর তালিকায় গ্যাস দুর্ঘটনার ভূমিকা ক্রমে বেড়ে চলা উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ এই সমস্যা নিয়ে ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না। দুর্ঘটনার খবর পেলে ফায়ার সার্ভিস সেখানে যায়। কিন্তু দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কোনো সচেতন নাগরিক এ বিষয়ে সরকারের ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন, এসব দুর্ঘটনা এড়ানোর কিছু কৌশলও হয়তো বাতলে দিচ্ছেন, কিন্তু কোনো পেশাদার কর্তৃপক্ষ বা বিশেষজ্ঞ মহলকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত ২ ডিসেম্বর জনস্বার্থে একটা রিট করেন। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে বিবাদীদের এই ব্যর্থতাকে কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ বলা হবে না এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে ওই রুলে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদসচিব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকসহ পাঁচটি দায়িত্বশীল দপ্তরের পাঁচজন নির্বাহীকে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটা পরিপত্র জারি করেছে। ওই পরিপত্রে তিনটি ধাপে সতর্কতা অবলম্বনের উপায় বলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে এই: এক. সিলিন্ডার রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ, দুই. রান্না শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে গৃহীত সতর্কতা এবং সিলিন্ডার রাখার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, তিন. রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথভাবে বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এটা অবশ্যই একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর পরে নিশ্চয়ই আরও বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে। যেমন সিলিন্ডার ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও সব সিলিন্ডার ব্যবসায়ীকে এ আদেশ দেওয়া যে সিলিন্ডার বিক্রির আগে তাঁরা অবশ্যই ক্রেতাকে এমএসডিএস (ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিট) দেখাবে এবং সিলিন্ডারের সঙ্গে তা ব্যবহারের নিয়মকানুন ও প্রয়োজনীয় সতর্কতাসংবলিত লিফলেট বিতরণ করবে।
বাংলাদেশের মতো ভারতেও গৃহস্থালিতে সিলিন্ডারের ব্যবহার চলছে। সেখানেও এমন দুর্ঘটনা ঘটে। এই সমস্যা মোকাবিলায় তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করা উচিত। তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগতে পারে। পাইপলাইনের গ্যাসের লিকেজ বন্ধ করার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যুক্তরাজ্যের হেলথ অ্যান্ড সেফটি কর্তৃপক্ষ ও গ্যাস সেফটি নেটওয়ার্ক এ বিষয়ে তৎপর। তারা গ্যাস ব্যবহারকারীদের কারিগরি দিকনির্দেশনা দেয়। যেমন: নিজে লিকেজ বন্ধ করতে যাবেন না, কর্তৃপক্ষকে জানান। ওই বিল্ডিং থেকে সবাইকে বের করে দিন। ওই বিল্ডিংয়ের আশপাশ দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিন। ধূমপান করা, মোবাইল ফোন বা যেকোনো অগ্নি–উৎপাদক বস্তু সেখান থেকে সরিয়ে নিন। দুর্ঘটনা বন্ধ করতে আসা কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করুন।
রাশেদ রাফি, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষক
sea.sky.rafi@gmail.com