বিনোদনের রাজনীতি

মানুষ খুব কষ্টে আছে। বাজার অস্থির। চাল, ডাল, মাছ, সবজি, মাংস, মসলা—সবই আক্রা। তবে সবাই যে সমস্যায় আছেন, তা নয়। এক মন্ত্রী তো বলেছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আরেক মন্ত্রী বলেছেন, এখন লোকে চাইলেই তিন বেলা মাংস খেতে পারে। সংস্কৃতে একটি কথা আছে, ঘ্রাণং অর্ধং ভোজনং। এটাকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, শ্রবণং অর্ধং ভোজনং। এসব কথা শুনলে মানুষ অভাব কিংবা দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায়। তারা বিনোদন পায়। ইদানীং বিনোদনের খরচ খুব বেড়ে গেছে। তবে নিখরচায় বিনোদন বিলিয়ে যাচ্ছেন আমাদের মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদেরা, এটাও তো দেশসেবা!

কিছুদিন আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র বলেন, ইরাক আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র ভুল করেছে। এ নিয়ে বেশ হইচই হলো। ‘ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ লুকিয়ে রাখার গল্পটি ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে আবিষ্কার করেছিলেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। জর্জ বুশ সঙ্গে সঙ্গেই তা লুফে নেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশের একটি জোট ইরাকে আক্রমণ চালিয়ে দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তবে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রাণঘাতী সেসব অস্ত্র তারা পায়নি, যার কেচ্ছা তারা প্রচার করে যুদ্ধের অজুহাত তৈরি করেছিল। বুশের গলায় ইরাক যুদ্ধ নিয়ে এই মন্তব্যে অনেকেই নড়েচড়ে বসেন। তাহলে কি তাঁর বোধোদয় বা অনুশোচনা হচ্ছে? না। প্রচণ্ড আলোচনা-সমালোচনার মুখে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, অন্য একটি দেশের কথা বলতে গিয়ে মুখ ফসকে ইরাকের নাম বেরিয়ে পড়েছে। এটা স্লিপ অব টাং।

আমরা তো এখন আর গরিব দেশ নই। এলডিসির জাল থেকে ছুটে এখন আমরা মধ্য আয়ের দেশ। আমাদের অনেক কিছুই এখন আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে যাচ্ছে। আমরাও খুশিতে বগল বাজাচ্ছি।

আমাদের সাবেক গভর্নর মোনেম খানের আমলে তৈরি হয়েছিল কমলাপুর রেলস্টেশন। তখন প্রচার ছিল, এটি এশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন। স্টেশনটির স্থাপত্য ভারি সুন্দর, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর আকার! যারা কখনো দেশের বাইরে পা রাখেনি, তারা অনেকেই এটা বিশ্বাস করেছিল। অথচ পাশের দেশ ভারতেই এর চেয়ে বড় রেলস্টেশন আছে গোটা বিশেক কিংবা তারও বেশি। একটা এলাকার মানুষ যদি বোকাসোকা, বুদ্ধিহীন হয় কিংবা অরাজক অবস্থায় চলে, আমরা সেটাকে বলি মগের মুলুক। দেশটাকে মগের মালুক ভেবে শাসকেরা অনেক সময় রঙ্গ-রসিকতা করেন।

গত শনিবার ঢাকার এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত বিতর্ক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সেখানে তিনি বলেছেন, বেশ কিছু কেন্দ্রে শতভাগ ভোট প্রদান ছিল অস্বস্তিকর। বেশ ফাটাফাটি মন্তব্য। দায়িত্বে থাকাকালে বললে কিংবা এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে তিনি বাহবা পেতেন। বেশি দেরি হয়ে গেল না? যাহোক, আমি এতে বেশ বিনোদন পাচ্ছি। আমার ওই প্রবাদটির কথা মনে পড়ে গেল—এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! কে এই মন্থরা?

হিন্দু পুরাণে আছে, রাজা দশরথের স্ত্রী রানি কৈকেয়ীর বাবার বাড়ি থেকে আসা কুব্জা দাসী। সে বিকৃতাকার, বক্রদেহী, হিংসুটে এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। কুমন্ত্রণা দেওয়ার ব্যাপারে নিপুণ হলেও সে ছিল কৈকেয়ীর প্রকৃত হিতৈষী। সে কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দেয়, রাজা দশরথ শম্বরাসুরের যুদ্ধে আহত হলে কৈকেয়ী তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে এনে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন। দশরথ তখন এই রানিকে দুটি বর দেন। এখন সেই সময় উপস্থিত হয়েছে। কৈকেয়ীর উচিত প্রথম বরে তাঁর পেটের ছেলে ভরতকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা এবং সপত্নীপুত্র রামকে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে পাঠানো। সত্য রক্ষার জন্য দশরথ এটা মেনে নেন। অর্থাৎ মন্থরার কুমন্ত্রণায় রাম গেলেন বনবাসে। আমরা তো বলতে পারি, বনবাসে গেল গণতন্ত্র, ১৪ বছরের জন্য। তবে পুরাণ আর ইতিহাস এক বস্তু নয়। রামায়ণের কাহিনি দিয়ে সবকিছু কি বিচার করা চলে? আধুনিক রামায়ণ যাঁরা লেখেন, কে এম নূরুল হুদাকে কি আমরা তাঁদের দলে ফেলব?

বিনোদনপ্রিয় কর্তাদের আমার ভালোই লাগে। অন্য কোনোভাবে সংবাদ শিরোনাম না হতে পারলেও বিনোদন বিলিয়ে তাঁরা সবার নজর কাড়েন। পদ্মা সেতুর প্রাক্‌–সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে বিএনপির আমলে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার এটি হাতে নেয়। তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা। পদ্মা সেতু তৈরি হয়ে গেছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।

ইদানীং ইভিএম নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। এটি হুদা কমিশনের সময় বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়। গত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এটি পুরো মাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছিল। তখন ভোটকেন্দ্রে নানান কাণ্ড ঘটেছিল বলে গণমাধ্যমে ও জন–আলোচনায় জানা যায়। আঙুলের ছাপ না মিললে ভোট দেওয়া যায় না। তার মানে, একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারবে না। কিন্তু তাতে কী? অদ্ভুত সৃজনশীল বাঙালি তো পথ একটা বের করবেই। হলোও তা-ই। টিপ দিলেন আপনি, আর ভোটের বাটন চাপানোর সময় আপনার ওপর সওয়ার হলেন আরেকজন। আপনার পছন্দের প্রার্থীর হিসাবে ভোটটা জমা পড়ল না।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আগামী নির্বাচনে একই পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী ইভিএম সম্পর্কে সোজাসাপটা বলেছেন, ‘আমরা বললে সুষ্ঠু, আমরা না বললে অসুষ্ঠু...তোমার আঙুল, টিপ দেব আমি’ (নৌকার প্রার্থী ও ইভিএম, সম্পাদকীয়, প্রথম আলো, ৫ জুন ২০২২)। একসময় স্লোগান ছিল, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। এখন তো এটা হয়ে গেল, তোমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। এর মধ্যেও বিনোদন আছে। আজকাল ‘গণতন্ত্র’ বড্ড একঘেয়ে শব্দ হয়ে গেছে। এ রকম কথা কেউ বললে বেশ মজা পাই।

বিএনপি একটি বড় দল। ক্ষমতায় ছিল অনেক বছর। আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার আশা রাখে। তো এহেন ক্ষমতাশালী বিএনপির এক লাইট-হেভিওয়েট নেতা রুহুল কবির রিজভী। তিনি শয্যা পেতেছেন নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসে। কেউ কেউ ট্রল করে তাঁকে বলেন বিএনপির আবাসিক নেতা। কয়েক দিন আগে তিনি একটি প্রচণ্ড হুংকার দিয়েছেন, ‘আমি যদি রাস্তায় নামি, তাহলে সরকার আর এক দিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’ সাংঘাতিক কথা! বিএনপি কয়েক বছর ধরেই ‘সরকার পতনের’ আন্দোলন করছে। বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। মিছিল-সমাবেশ করলেই পুলিশ কিংবা সোনার ছেলেরা তাদের ঠেঙায়। প্রশ্ন হলো, রিজভী সাহেব রাস্তায় নামছেন না কেন?

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। টেলিভিশনে তাঁকে দখলেই আমি চিন্তায় পড়ে যাই, এবার তিনি কী বলবেন! একবার বললেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মতো। বিষয়টি আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন প্রেম-ভালোবাসা থাকে, তেমনি ঝগড়াঝাঁটিও হয়। রাগ আছে। তবে শেষমেশ দেখা যাবে অনুরাগ জয়যুক্ত হয়েছে। মানুষের মুখ তো আর টেপ দিয়ে আটকে রাখা যায় না!

বিনোদনপ্রিয় কর্তাদের আমার ভালোই লাগে। অন্য কোনোভাবে সংবাদ শিরোনাম না হতে পারলেও বিনোদন বিলিয়ে তাঁরা সবার নজর কাড়েন। পদ্মা সেতুর প্রাক্‌–সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে বিএনপির আমলে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার এটি হাতে নেয়। তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা। পদ্মা সেতু তৈরি হয়ে গেছে। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।

আমি পারছি না, কিন্তু তুমি করে ফেললে। এটা যেন কেমন-কেমন। ঈর্ষা হওয়া স্বাভাবিক। তো খালেদা জিয়া বললেন, পদ্মা সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে, এটার ওপর উঠবেন না, ভেঙে পড়ে যাবে। ব্যাপারটি মনে রেখেছেন শেখ হাসিনা। কয়েক দিন আগে তিনি মোক্ষম একটা জবাব দিলেন। বেশ রস করেই বললেন, এখন যদি খালেদা জিয়াকে সেতুর ওপর থেকে টুস করে নদীতে ফেল দিই, তাহলে কমন হবে?

বাঙালি কৌতুকপ্রিয় হলেও সবাই কৌতুক বোঝেন না। কেউ কৌতুককে নেন সিরিয়াসলি আর সিরিয়াস কথাকে নেন কৌতুক হিসেবে। তো বিএনপির বরকন্দাজরা হইচই শুরু করলেন—দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে নদীতে চুবিয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই হলো আমাদের রাজনীতি।

রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু সেসব হলো কথার কথা। তাতে কী? আমরা তো বিনে পয়সায় বিনোদন পাই।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক