ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাব-জোনাল অফিসের এজিএম শেখ আবদুর রহমান গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে দুজন লাইনম্যান ও একজন ওয়্যারিং পরিদর্শক নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া শুরু করেছেন। তাতে করে দীর্ঘ অপেক্ষা, হয়রানি, ভোগান্তি ও বাড়তি অর্থ খরচ (ঘুষ) ছাড়াই গ্রাহকেরা নতুন সংযোগ পাচ্ছেন। ৪ দিনে এভাবে তিনি ৫৪টি সংযোগ দেন। তিনি এই কর্মসূচির নাম দিয়েছেন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। এই মডেল অনুসরণ করে দেশের গ্রামাঞ্চলে শনিবার থেকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৮০০ রিকশা-ভ্যান নামার কথা রয়েছে, সেগুলো বাড়ি বাড়ি যাবে। ভ্যানগুলোতে থাকবে বিদ্যুতের মিটার, তারসহ বিদ্যুতের নতুন সংযোগ দেওয়ার সব সরঞ্জাম। গ্রাহক বিদ্যুতের সংযোগ চাইলে তাৎক্ষণিক সব প্রক্রিয়া শেষে দেওয়া হবে নতুন সংযোগ।
বিদ্যুৎ সংযোগকে ঘুষহীন ও হয়রানিমুক্ত করার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এই ব্যক্তি উদ্যোগ বিদ্যুৎ বিতরণ প্রশাসনের গ্রাহক হয়রানি ও ঘুষ জালিয়াতির সাক্ষাৎ প্রমাণ। তবে এই বিকল্প মাধ্যমে গ্রাহক বাড়বে, ফলে বাড়বে লোড চাহিদা।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সমস্যা হচ্ছে এখানে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি কিন্তু সঞ্চালন সক্ষমতা তা থেকে পিছিয়ে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যাসংকুল ক্ষেত্র হচ্ছে বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা (ব্রাঞ্চ লাইনের ক্যাপাসিটি, ট্রান্সফর্মার ক্যাপাসিটি)। দেশে ২৬ থেকে ৩০ হাজার ট্রান্সফর্মার ওভার লোডেড থাকে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে। উচ্চ বিদ্যুৎ লোডে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোতে হাজার হাজার (মাসে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০০০-এর রেকর্ড রয়েছে) ট্রান্সফর্মার পুড়ে যায়। নতুন এই উদ্যোগ বিতরণ ব্যবস্থায় চাপ তৈরি করবে। যদি নতুন উদ্যোগের সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানোকে প্রাক্কলন (ক্যাপাসিটি গ্রোথ ফোরকাস্ট) করে বিতরণ ব্যবস্থা (ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম) রিডাইমেনশন করে সক্ষমতা সেভাবে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলেই টেকসই হবে এই খাতের উন্নয়ন। অন্যথায় এই উদ্যোগে লোডশেডিং বাড়বে এবং আরও বেশি নিম্নধাপী বিতরণ ট্রান্সফর্মার পোড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে গ্রীষ্মকালে।
আমাদের উচ্চ ইনস্টলড ক্যাপাসিটি আছে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট অথবা অলস অথবা বেশ নিম্ন ইফেসিয়েন্সির। তাও আবার এই উৎপাদন সক্ষমতাও সঞ্চালন-বিতরণ অক্ষমতার কারণেও অনুৎপাদনশীল। অথচ এর বিপরীতে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে (ক্যাপাসিটি চার্জ মেগাপ্রতি ৭০০ ডলার প্রায়)। একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ। একই সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ে ১২৩ শতাংশ। অথচ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন বেড়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী তা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সামঞ্জস্যহীন উন্নয়নের অসমন্বিত ও অস্থায়িত্বশীল মডেলে দেশের অর্থনীতি ও দৈনন্দিন যাপিত জীবনের মান অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রীষ্মের শুরু থেকেই লোডশেডিং নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রবৃদ্ধি! বিগত সময়ে বিএনপি সঞ্চালন-বিতরণ উন্নয়নে কিছু কাজ করেছে তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো সফলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। উৎপাদন না বাড়িয়ে গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন বাড়ানোয় (যা থেকে খাম্বা মিথের উদ্ভব) চাহিদা বেড়েছে। একদিকে বিতরণে চাপ বাড়ায় লোডশেডিং বেড়েছে, অন্যদিকে উৎপাদন বাড়েনি। উৎপাদন না করে সঞ্চালন বৃদ্ধি অদূরদর্শী ছিল।
মুদ্রার অপর পিঠে বর্তমান সরকার ২০০৯ থেকে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধির মহাযজ্ঞ করেছে, যাতে ২০১৮ পর্যন্ত পিডিবির প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ও দুর্নীতিতে লোকসান (বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন) হয়েছে। কিন্তু উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণের অবকাঠামো সেভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তুলছে না বলে এই উৎপাদন সক্ষমতাও অনুৎপাদনশীল, অ-টেকসই এবং অদূরদর্শী হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ চাহিদার অনুকূলে উৎপাদন এবং উৎপাদনের বিপরীতে সঞ্চালন ও বিতরণের ব্যবস্থা সব সরকারের আমলেই অদূরদর্শী ও সামঞ্জস্যহীন থেকে গেছে।
আবাসিক সংযোগের চেয়েও বেশি পরিমাণ হয়রানি ও ঘুষ জালিয়াতির ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে বিদ্যুতের শিল্প সংযোগে। শিল্প খাতে বিদ্যুতের নতুন সংযোগ প্রদানে বিলম্বের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুইং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৭’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নতুন শিল্প-কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ পেতে বাংলাদেশে প্রায় ৪০৪ দিন তথা ১ বছর ২ মাসের মতো সময় লাগে।
২০১৭ নাগাদ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও ডিসিসিআইয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কয়েক হাজার শিল্প-কারখানার নতুন সংযোগের আবেদন জমা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (ডিপিডিসি) পড়ে আছে ১ হাজার ৭০০টি আবেদন। এ ছাড়া ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) কাছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ছয়টি ইউনিটের আওতায় আড়াই হাজার নতুন সংযোগের আবেদন জমা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
শেখ আবদুর রহমান ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ উদ্যোগের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগের ব্যবস্থা করছেন। আশা করি ঝিনাইদহে তাঁর নিজ এলাকার বাইরেও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে এই উদ্যোগ। এখন কর্মসংস্থানের উৎস শিল্প-কারখানায় সংযোগ দিতে ভিন্ন আরেকটি উদ্যোগের দরকার পড়েছে, যাতে আলো এবং কর্মসংস্থান উভয়েরই ফয়সালা হয়। বছর দু-এক আগে মন্ত্রণালয় বলেছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শিল্প সংযোগের ব্যবস্থা করা হবে, আদতে তা বেহুদা কথাতেই থেকে গেছে! এসব বেহুদা কথাতেই আটকে যাচ্ছে আমাদের উদ্যোক্তা ও তরুণদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনা। ফলে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’র পাশাপাশি দরকার পড়েছে নতুন একজন ‘আলো ও কর্মসংস্থানের যৌথ ফেরিওয়ালা’র। বিদ্যুৎ প্রশাসনে কেউ কি আছেন কর্ম ও জীবনের আশা জাগানিয়া?
লেখক: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাকটিভিস্ট, সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট, প্রকৌশলী
faiz.taiyeb@gmail.com