বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি অপচয়ে আমরা কত সিদ্ধহস্ত, তা আমার ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্বের সূচনালগ্ন থেকে আজ প্রশাসনের মধ্য সোপানে এসে উপলব্ধি করছি, জাতির জন্য এটা কত গ্লানিকর। জ্বালানি সাশ্রয়ে বিশ্বব্যাপী এখন নিরন্তর গবেষণা ও উদ্ভাবন চললেও আমরা পিছিয়ে আছি শতাব্দী যোজন দূরে।
দেশে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে গাড়ির ছড়াছড়ি। গাড়ি কেনা ও ব্যবহারে লাগামহীন অর্থের ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে। মাত্র ১০০ গ্রাম কাঁচা মরিচ বা একটা পাউরুটি কিনতে বাজারে ছুটছে গাড়ি। বাড়িতে-অফিসে ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর (কম্পিউটার, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, মোবাইল, মাইক্রোওয়েভ) চার্জারটি সকেটের সঙ্গে অবিরাম অবিচ্ছিন্ন রেখে আমরা বিদ্যুতের অপচয় ঘটাচ্ছি। এসির ব্যবহারেও রয়েছে অজ্ঞতা ও অবহেলা। এসির এয়ার ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে অন্তত ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। অবিরাম না চালিয়ে বিরতি দিলে এসির ব্যবহারেও বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়। মাত্র ১০০-১৫০ বর্গফুটের ছোট ছোট দোকানে একসঙ্গে এক বা দুই ডজন বাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। অতিরিক্ত বাতি ব্যবহার করলে কক্ষের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তা শীতল করতে প্রয়োজন হয় এসি বা ফ্যানের ব্যবহার।
রাজধানী ঢাকায় বহু অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দা ও সিঁড়িঘরের বাতি জ্বলে সকাল সাত-আটটা পর্যন্ত, অথচ প্রাকৃতিক আলোয় তখন ভরে যায় চারপাশ। শীতকালে উষ্ণ পানির ব্যবহার শেষে বাথরুমের গিজারটি চালু থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সরকারি অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায়ই বাতি-ফ্যান-এসি চালু রেখে নামাজে, সভায় কিংবা মধ্যাহ্নভোজে চলে যান। ঘুমন্ত এ জাতিকে জাগাবে কে? বগুড়ায় এডিসি থাকা অবস্থায় প্রাতর্ভ্রমণে বের হয়ে দেখতাম, সকাল সাতটা পর্যন্ত পৌরসভার সড়কবাতিগুলো জ্বলছে। পরে পৌর মেয়রকে চিঠি দিয়ে এ অপচয় বন্ধ করেছি। সম্প্রতি সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তার কক্ষে দেখি, ভরদুপুরে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত অথচ একসঙ্গে ছয়টি গুচ্ছ টিউব বাতি জ্বলছে, তাৎক্ষণিক তাঁকে সাশ্রয়ী হওয়ার পথনির্দেশনা দিই। বহু সরকারি-বেসরকারি অফিসের জানালা ভারী পর্দা দিয়ে আবৃত রেখে কৃত্রিম অন্ধকারে ঢেকে ডজন ডজন বাতি জ্বালানো হয়। দিনের বেলা পর্দা সরিয়ে বাতির ব্যবহার কমালে সাশ্রয় হয় প্রচুর বিদ্যুৎ।
২০১১ সালে জাপানে প্রবল শক্তির ভূমিকম্প-সুনামির আঘাতে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে বিদ্যুতে রেশনিং শুরু হয় এবং দুর্যোগ-পরবর্তী কয়েক মাস এসির তাপমাত্রা ২৪০ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা হয়। জাপানিরা সরকারি নির্দেশনা সর্বান্তকরণে প্রতিপালন করে। অথচ বাংলাদেশে রাত আটটার পর শপিংমল, মার্কেট বন্ধ রাখার নির্দেশনা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়েও পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। দোকানে-প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ কতটি বাতি ব্যবহৃত হবে, তা বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক রেশনিং করার সময় এসেছে। সেবা খাতে সুশাসন নেই বলে আমরা সমালোচনায় মুখর হই। কিন্তু নাগরিক হিসেবে প্রতি পদে পদে কেন আমাদের আইন অমান্যতা ও অপচয় প্রবণতা, তা সামাজিক বিশ্লেষণে খুঁজে পাই না। সিএফএল বাতির ব্যবহারেও প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। চুলা থেকে তুলে এনেই গরম গরম খাবার তাৎক্ষণিক রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা অনুচিত। কারণ, গরম খাবার শীতল হতে প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন।
সম্প্রতি প্রযুক্তির কল্যাণে বাজারে আসছে ‘গ্রাফিন’ নামক উপাদানে তৈরি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব। কাচের মতো স্বচ্ছ এ উপাদান ইস্পাত অপেক্ষা প্রায় ২০০ শতাংশ শক্ত। কানাডার এক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় এ প্রযুক্তি চালু করছে। বাল্বের ফিলামেন্টেই ‘গ্রাফিন’ নামক উপাদানটি থাকবে, যা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী, টেকসই ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক। ‘এসটি মাইক্রোইলেট্রনিকস’ নামক সুইস সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে ‘এনার্জিপ্যাক’ নামক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে ২০১৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎসাশ্রয়ী নানা প্রযুক্তি যেমন সিএফএল বাতি, স্বয়ংক্রিয় মোটর-কক্টেরালার, পাওয়ার সিস্টেম ক্যাপাসিটরের ব্যবহার এবং সার্বিকভাবে লোড ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত রাখতে পারলে দৈনিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব, এতে বিদ্যুৎবঞ্চিত জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, সড়কপথের চেয়ে আকাশপথের পরিবহন ব্যবস্থা অনেক জ্বালানিসাশ্রয়ী। যানবাহনে এক মাইল ভ্রমণে যেখানে জ্বালানির প্রয়োজন ৪ হাজার ২১১ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট, সেখানে একই দূরত্বে বিমানযাত্রায় প্রয়োজন ২ হাজার ৪৬৫ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট। বিমান নির্মাতাদের তৈরি নতুন মডেলের বিমানগুলো এখন অধিক জ্বালানিসাশ্রয়ী। অথচ সড়কপথে বাস, ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যানে পোড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ লিটার জ্বালানি তেল। যানবাহনের ইঞ্জিন ক্ষমতা এবং আকারেও নির্ভর করছে জ্বালানি ব্যয়। যে কারণে জাপান এখন জ্বালানিসাশ্রয়ী গাড়ি নির্মাণের অগ্রদূত। বিমানে যাত্রাপথ যত দীর্ঘ হবে, জ্বালানি ব্যয়ও তত হ্রাস পাবে। যাত্রাপথ কম হলে ঘটবে তার বিপরীত। এসব নিয়ে এখন পশ্চিমা বিশ্বে চলছে প্রতিনিয়ত গবেষণা ও সমীক্ষা, যার লক্ষ্য জ্বালানি সাশ্রয়। অথচ বাংলাদেশে অপচয় ও অপব্যবহারে আমরা কত বিবেকহীন, উদাসীন।
সাভারে সিভিল সার্ভিসের মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্সে দেখেছি, কিছু কর্মকর্তা ছুটির দিনে সিলিং ফ্যান চালু রেখে কক্ষে তালা দিয়ে সারা দিন বাইরে থাকতেন। বিষয়টি অনৈতিক হিসেবে কর্তৃপক্ষের গোচরে এনেছিলাম। তাঁদের সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎ অপচয়ের জন্য সর্বস্তরে সাশ্রয়ী মনোভাবের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সাবধান না হলে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে আমাদের। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত সমগ্র বাংলাদেশকে প্রিপেইড মিটারিংয়ের আওতায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিদ্যুতের অপব্যবহার ও অপচয় রোধে বিদ্যমান বিদ্যুৎ আইনে জরিমানার বিধান সংযোজন করে তা ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনতে হবে। অপচয়ের ব্যাপারে আত্মোপলব্ধি না এলে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অপচয় ও চুরি থেকে নিরাপদ রাখতে হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদকে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: (স্পেশাল টাস্কফোর্স প্রধান) ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
mmunirc@gmail.com