সেবামূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের সেবার মান শীর্ষে আনতে আমরা আন্তরিক। কিন্তু বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে আমাদের আছে বহুমাত্রিক অসততা। বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দেওয়ার অনৈতিক প্রবণতা প্রমাণ করে জাতি হিসেবে আমাদের অসুস্থ মানসিকতা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে গত তিন মাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিদ্যুৎ নিয়ে বহু গ্রাহক জড়িয়ে আছেন নানা অনিয়মে।
এমনকি শিল্পোদ্যোক্তা ও সমাজের এলিট শ্রেণির একটি অংশ নানা কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বড় হওয়ার অন্যায় অভিলাষে তাড়িত। এক শিল্পপতি ১০ বছরে সাত কোটি টাকা বিল বকেয়া রেখে এখন তা হ্রাস করার কৌশল খঁুজছেন। আবার কোনো কোনো শিল্পগ্রাহক বিরাট অঙ্কের বকেয়া রেখে আত্মরক্ষার্থে মামলা দিয়ে চোরাপথে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। মামলার জালে আটকা পড়েছে ডিপিডিসির প্রায় ১০০ কোটি টাকার রাজস্ব। মামলা নিয়ে আদালত অঙ্গনে ছোটাছুটি করছেন কর্মকর্তারা। দীর্ঘ আইনি যুদ্ধে অবতীর্ণ
হয়ে গত ছয় বছরে ডিপিডিসির মামলার ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২০ কোটি টাকারও বেশি। নতুন ডিজিটাল মিটারিং ব্যবস্থায় অন্যায্যভাবে বিদ্যুৎ বিল আরোপের অবকাশ নেই, তথাপি মিথ্যা অপবাদ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে।
আরেক শিল্পপতি তাঁর কারখানার দুই কোটি টাকা বিল বকেয়া রেখে সম্প্রতি মারা যান। মিটার টেম্পারিং করে বিদ্যুৎ চুরিতে সিদ্ধহস্ত এ ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তাঁর কারখানা আরেক শিল্পপতির কাছে বিক্রির উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে পুরান ঢাকায় দস্যুতা স্টাইলে রাতে ‘হুকিং’-প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু কারখানায় বিদ্যুৎ চুরি ঘটছে। রাজধানীর এক মার্কেটে প্রায় ৪৭ লাখ টাকা বকেয়ার দায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর সম্প্রতি রাতের অভিযানে বেআইনি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ঘটনা ধরা পড়ে। মার্কেটের প্রায় ২০০ গ্রাহক এ অপরাধে জড়িত। অভিযান চালিয়ে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। গুলশানের এক ব্যবসায়ী সাড়ে ১৩ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করার ফন্দি হিসেবে মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে বিছানায় দুই মাস ধরে শুয়ে আছেন। অভিযানে বিদ্যুৎ চুরি ধরা পড়লেই সৃষ্টি হয় গ্রাহকের অজুহাত ও নেপথ্যে অন্যায় চাপ।
সেবা খাতকে যদি পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, তবে উন্নয়ন ও মান বৃদ্ধি ঘটবে কীভাবে? বুড়িগঙ্গার সন্নিকটে চার-পাঁচ বছরের বিদ্যুৎ বিল (গড়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা) বকেয়া রেখে কোনো কোনো শিল্পপতি কারখানা বন্ধ/বিক্রি করে গা ঢাকা দিয়েছেন। একদিকে বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দেওয়া ও বিদ্যুৎ চুরি করা, অন্যদিকে সামাজিক সুনামের লক্ষ্যে ‘সিএসআর’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন মূলত করপোরেট অপরাধের শামিল। ডেসা আমলে অ্যানালগ মিটারভিত্তিক বহু আবাসিক/বাণিজ্যিক গ্রাহক বিরাট অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল
থেকে অনৈতিকভাবে অব্যাহতি পেতে পুরোনো মিটার ফেলে দিয়ে ভিন্ন নামে সংযোগ নিয়েছেন। দুর্নীতির এ দুষ্টপাকে জড়িত হয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মী। রাজধানীর অভিজাত এলাকার এলিট শ্রেণির কিছু নাগরিক পুরোনো আবাসিক ভবনের বিরাট অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে হাউজিং কোম্পানির কাছে তা বিক্রি করে অন্য এলাকায় কেটে পড়েছেন।
বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে অভিযান: কেউবা বিদেশে কিংবা চূড়ান্ত গন্তব্যে (পরপারে) পাড়ি জমিয়েছেন। এমনকি আবাসিক এলাকার অনেক গ্রাহক অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত লোড বেআইনিভাবে ব্যবহার করছেন। আবার কোনো কোনো গ্রাহক ৫০ কিলোওয়াটের নিচে বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে রাজস্ব ফাঁকির উদ্দেশ্যে ৫০ কিলোওয়াটের অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করছেন। ৫০ কিলোওয়াট ঊর্ধ্বের গ্রাহকেরা উচ্চচাপ গ্রাহক হিসেবে গণ্য হন। কিন্তু নিম্নচাপের গ্রাহক সেজে অনৈতিকভাবে উচ্চচাপের গ্রাহক হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে সিস্টেম ওভারলোড ও মূল্যবান ট্রান্সফরমার বিকলের ঘটনা ঘটছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ গ্রাহক। এর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় সাবস্টেশনগুলো ওভার লোডজনিত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার ওপর এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাপে কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক কালে এক্সপ্রেস ফিডার, অত্যাধুনিক ডিজিটাল মিটার, প্রি-পেইড মিটার ইত্যাদি প্রবর্তনের ফলে বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতির ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পেলেও গ্রাহক পর্যায়ে চুরি/রাজস্ব ফাঁকির মানসিকতা পুরোপুরি দূর হয়নি। এ মানসিকতা জাতি হিসেবে অত্যন্ত অমর্যাদাকর। নাগরিকদের একটি অংশের বিবেকহীন এসব অনৈতিকতা প্রতিরোধে ডিপিডিসির একদল কর্মকর্তাকে দাপ্তরিক কাজ ফেলে মাঠে ঘাম ঝরিয়ে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত শ্রম, সময় ও যানবাহনের জ্বালানির ব্যয় বাড়ছে। দেশপ্রেম ও নাগরিক সচেতনতার অভাবে এসব অনিয়ম সংক্রমিত হয়েছে। এসব ঘটনা রীতিমতো গবেষণার বিষয়, যা হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসের জন্ম দেবে।
তবে টাস্কফোর্সের অব্যাহত অভিযান ও কর্তৃপক্ষের নজরদারির চাপে এসব ঘটনার বেপরোয়া মাত্রা অনেক হ্রাস পেয়েছে। ডিপিডিসির সিস্টেম লস ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ২০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। শতভাগ ডিজিটাল ব্যবস্থায় আমরা পৌঁছে যাব অচিরেই। তখন অনৈতিকতার আর থাকবে না সুযোগ, রুদ্ধ হবে দুর্নীতির শত ছিদ্রপথ। নাগরিকদের সবিনয়ে অনুরোধ জানাব, এসব অনৈতিকতার চর্চা বন্ধ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভয়ানক পঙ্কিলতায় আক্রান্ত হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া তরুণ নির্বাহীরা বিদ্যুৎ ও গ্যাস চুরির মতো মারাত্মক অপরাধমূলক কাজে মালিকদের কাছ থেকে দীক্ষা পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ দ্রুত বড়লোক হওয়ার অসৎ পথ বেছে নিচ্ছে, অল্পতেই গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে যাচ্ছে। এভাবেই এসব অনৈতিকতার চর্চা সমাজে দুর্নীতির অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে।
অতএব প্রয়োজন বিদ্যুতের সদ্ব্যবহার ও সুরক্ষা এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচ্ছন্নতা। আমরা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য সরকারকে দায়ী করি অবলীলায়। কিন্তু বিদ্যুৎ চুরি, অপচয় ও রাজস্ব ফাঁকির জন্য দায়ী কে? বিদ্যুতে জড়িত আছে জাতির সামষ্টিক স্বার্থ। বিদ্যুৎ কারও ব্যক্তিস্বার্থে নয়। বিদ্যুৎ চুরি ও রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে। নাগরিকদের ভেতর থেকে আসতে হবে সততা। এ জন্য প্রয়োজন নৈতিকতার শিক্ষা। শাসন করে সততা তৈরি কিংবা আইন করে নৈতিকতা সৃষ্টি করা যায় না। বিদ্যুৎ চুরি শুধু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, সামাজিক বঞ্চনা সৃষ্টি করছে অন্যদের জন্যও। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই অনৈতিকতা যেন প্রলম্বিত না হয়। সুশাসন ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে নাগরিক সততাও অপরিহার্য। নিজে সৎ না হয়ে অন্যের কাছ থেকে সদাচরণ কেন আশা করব? তাই উন্নত মানের বিদ্যুৎসেবা প্রাপ্তির জন্য বদলাতে হবে রাষ্ট্রকে ঠকানোর নিম্নমানের চিন্তা ও চেতনা।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: বিদ্যুৎ চুরি রোধ, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত স্পেশাল টাস্কফোর্স–প্রধান ও সচিব, ডিপিডিসি।
mmunirc@ gmail.com