চরশাখাহাতী ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৮৯। রমনা ১ নম্বর, বজরা দিয়ারখাতা ও চিলমারী ১ নম্বর। তিনটিই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল যথাক্রমে ১৯০৪, ১৯০৫ ও ১৯১৬। চিলমারীর মতো সারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজের অধিকাংশই হয়েছে জনগণের উদ্যোগে। তাঁদের সন্তানেরা যাতে একটু শিক্ষা পায়—এমন আশায় স্কুল-কলেজে জমি দিয়েছেন। অথচ ব্রহ্মপুত্রের চরে এটা নিয়ম হয়ে গেছে—শিক্ষিত হলেই সেই সন্তান আর চরে থাকবে না, আর নিজ বাপ-চাচাকে ছোট জানবে।
২.
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে সভাপতি পদে যোগ্যতা হিসেবে চাওয়া হয়েছে স্নাতক পাস। ওপরের স্কুল চারটির মধ্যে রমনা ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া বাকি তিনটিতেই সভাপতি পদে স্নাতক পাসধারী লোক পেতে রীতিমতো অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে। আর চারটির একটিতে ফৌজদারি মামলার আসামিকে সভাপতি করা হয়েছে।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘জানেনই তো, জোর যার মুল্লুক তার।’ এ ছাড়া অন্য স্কুলগুলোর আওতাধীন এলাকায় একাধিক বিএ পাস লোক পাওয়া গেলেও তাঁরা পরিচালনা কমিটিতে আসতে অনাগ্রহী। ব্রিটিশ উপনিবেশের শিক্ষা তো এই, শিক্ষিত হওয়া মানেই বিচ্ছিন্ন হওয়া। আর দুর্নীতিবাজেরা নিজের সন্তানকে অক্সফোর্ড-হার্ভার্ডে পড়ালেও এলাকাবাসীর জন্য মাদ্রাসা বানায়। মানে হলো জনগণের মধ্যে বৈষম্য বাড়াও। মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আর নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখা আজ ধুলায় লুটায়।
সংবিধানের মূল চেতনা হলো জনগণই সার্বভৌম। সেই জনগণের বদলে বাছাই করা বিএ পাসধারীদের কর্তৃত্বে সামাজিক মালিকানার বিদ্যালয়ের পরিচালনার ভার প্রদানের সুযোগ নেই। কোনো উকিল হয়তো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বিরুদ্ধে রিট করবে না উচ্চ আদালতে, তাতেও জনগণের কর্তৃত্ব খারিজ হয় না।
ব্রিটিশ আইন আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটিশরা নিজ দেশে জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আইন বানিয়েছে। দখলকৃত ভারতসহ উপনিবেশগুলো দখল রাখতে যে আইন চালু করেছে, তা হলো ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটেনে আইন বানিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ আর উপনিবেশে আইন বানিয়েছে ব্রিটিশ দখলদারেরা। অনেকে ভুল বোঝেন ইংল্যান্ডের মাটিতে ব্রিটিশ আইন দেখে। ওই আইন তো এখানে নেই। কিংবা কেউ ভাবেন, ব্রিটিশ আইনই যদি এখানে চালু থাকবে, তাহলে রাষ্ট্রাচরণে ব্রিটিশাচরণ নেই কেন? কারণ, ব্রিটেনের আইনে ব্রিটিশ জনগণের কর্তৃত্ব আর ব্রিটিশ উপনিবেশের আইনে দখলকৃত ভূখণ্ডে লুটকে বৈধতা দান ও অব্যাহত রাখার প্রয়োজনের কানুন। আমরা যখন ব্রিটিশ আইন বলি, তখন ভারত উপনিবেশকে শাসন ও দখল রাখার আইনকেই সংক্ষেপে ব্রিটিশ আইন বলি। তাই উপনিবেশের মানুষ সব সময় আধা মানুষ। উপনিবেশের জনগণের লড়াই তাই মানুষ হওয়ার লড়াই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ‘প্রচলিত আইন’-এর নামে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ঔপনিবেশিক আইন অব্যাহত রাখা হলো। ফলে রক্ত দিয়ে ‘দেশ পাইলাম বটে, কিন্তু দেশ আর নিজের হইল না!’
৩.
পূর্ব বাংলা মুসলমান, কৃষক আর তফসিলি জাতির দেশ। ঢাকার নবাব পরিবার ছাড়া গোটা দেশেই জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক তফাত ছিল না তেমন। সেই দেশে ৫ ভাগ লোকের হাতে ২৭ ভাগ সম্পত্তি চলে গেল। যারা জীবন দিয়ে দেশ বানায়, দেশের মালিকানা তারা পাওয়ার কথা। ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ সিনেমার জোস্না যেভাবে রাজকুমারের মালিকানার হকদার; ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে এরশাদ হটানো পর্যন্ত এই হক আদায়ের লড়াইটাই আমরা করেছি।
সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’-তে যতই লেখা থাকুক না কেন ‘আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য নহে’, কিংবা ৫৫ অনুচ্ছেদে নির্বাহী ক্ষমতার কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর, তবুও সংবিধানের মূল চেতনা হলো জনগণই সার্বভৌম। সেই জনগণের বদলে বাছাই করা বিএ পাসধারীদের কর্তৃত্বে সামাজিক মালিকানার বিদ্যালয়ের পরিচালনার ভার প্রদানের সুযোগ নেই। কোনো উকিল হয়তো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের বিরুদ্ধে রিট করবে না উচ্চ আদালতে, তাতেও জনগণের কর্তৃত্ব খারিজ হয় না। স্পষ্ট করে বললে চাষাভুষা জনগণের রক্তেই। সৈনিক ও পুলিশ ছিল জামাপরা কৃষকই। সেই চাষাভুষা জনগণের সন্তানেরা স্কুল-কলেজে পড়বে, আর তার দেখাশোনার ভার থাকবে ভদ্রলোকদের দায়িত্বে। এই ম্যানেজিং কমিটি তবে কার?
নাহিদ হাসান লেখক রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি।
nahidknowledge@gmail.com