মতামত

বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি বাংলাদেশকে যে সুবিধা দেবে

বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের একটি অংশ অনেক আগে থেকেই দেশের বাইরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। আমার একটি মজার অভিজ্ঞতা হচ্ছে ২০১১ সালে একটি বৃহৎ স্থানীয় ব্যবসা ও শিল্পগোষ্ঠীর হয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে কম্বোডিয়ার বৃহৎ কৃষিজমিতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদিত ফসলের কিয়দংশ দেশে আনার অনুমোদন চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাদামাটা উত্তর ছিল—প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা আইনে এ ধরনের আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই। অন্য একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে এক্সপোর্ট রিটেনশন বা রপ্তানি আয় সংরক্ষণ অ্যাকাউন্টে ৩০ মিলিয়ন ডলার থাকলেও মালয়েশিয়ায় একটি কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে গাইডলাইনের অভাবে অর্থ পাঠানোয় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগ বিষয়ে জারিকৃত নতুন বিধিমালায় অনুমতি পেয়েছে কিছু কোম্পানি। এতে আমি যথার্থই আনন্দিত হয়েছি। বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক প্রস্তাবিত বিধিমালা পর্যালোচনা কমিটিতে আমারও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

বিদেশে কোম্পানি এবং সহযোগী কোম্পানি খোলার ক্ষেত্রে অতীতে বাধা থাকলেও শাখা বা লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে অনেক স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের। বিশেষ করে বেশি রপ্তানি হয়—এমন তৈরি পোশাক বা ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান পণ্য বিপণনের সুবিধার্থে লোক নিয়োগ দিয়ে এ ধরনের অফিস পরিচালনা করে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে কোনো কোনো দেশে কোম্পানি খুলে উৎপাদন এবং ওই দেশসহ আশপাশের দেশে বাজারজাত করা সহজ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হবে। এসব কারণে মূলধন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেকে। বড় অনেক কোম্পানির সেই সামর্থ্যও হয়েছে।

এসব বিবেচনায় সরকার বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে গত ১৬ জানুয়ারি একটি বিধিমালা জারি করে। বিধিমালার আওতায় শর্ত সাপেক্ষে একজন রপ্তানিকারক তার ৫ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ অথবা নিট সম্পদের ২৫ শতাংশের মধ্যে যা কম, সে পরিমাণ বিনিয়োগের আবেদন করতে পারবেন। রপ্তানিকারকের সংরক্ষিত (রিটেনশন) কোটা বা ইআরকিউ হিসাব থেকে শুধু সমজাতীয় খাতে এ হারে বিনিয়োগ করা যাবে।

বিধিমালা করার কারণে এখন দেশের বাইরে স্থানীয়দের বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা যথার্থই মনে করছেন। পুরোপুরি উন্মুক্ত না হলেও নতুন এই বিধিমালা জারির ফলে বাংলাদেশ এ পথে একধাপ এগোল। বিধিমালায় বলা হয়েছে বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যক্তি ঋণখেলাপি হতে পারবেন না। উপরন্তু, কর পরিশোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হালনাগাদ সনদ লাগবে। যথাসময়ে রপ্তানি বিল ফেরত না এলে কিংবা আমদানি দায় অনিষ্পন্ন থাকলেও সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আবেদন গ্রহণ করা হবে না।

দেশ থেকে প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালে মিয়ানমারে একটি যৌথ মূলধনি কোম্পানিতে বিনিয়োগের অনুমতি পায় স্থানীয় একটি লুব্রিকেন্ট কোম্পানি। সব মিলিয়ে বৈধভাবে দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন রয়েছে ২২টি কোম্পানির। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যাচাই কমিটি এসব অনুমোদন দিয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে নতুন বিধিমালার ফলে আগের কমিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওই কমিটির অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টি কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ৬ কোটি ৯১ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার অনুমতি নিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে অর্থ নিয়েছে, তার অন্তত ৩টি বিনিয়োগ ফেরতও এনেছে।

বিধিমালা করার কারণে এখন দেশের বাইরে স্থানীয়দের বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা যথার্থই মনে করছেন। পুরোপুরি উন্মুক্ত না হলেও নতুন এই বিধিমালা জারির ফলে বাংলাদেশ এ পথে একধাপ এগোল। বিধিমালায় বলা হয়েছে বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যক্তি ঋণখেলাপি হতে পারবেন না। উপরন্তু, কর পরিশোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হালনাগাদ সনদ লাগবে। যথাসময়ে রপ্তানি বিল ফেরত না এলে কিংবা আমদানি দায় অনিষ্পন্ন থাকলেও সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আবেদন গ্রহণ করা হবে না।

পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যাচাই কমিটির সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারির সভায় ৪টি কোম্পানিকে ৫ দেশে ৯০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু প্রক্রিয়া শেষ করে এসব কোম্পানির বাইরে টাকা নিতে এখনো অপেক্ষা করতে হবে।

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী এমন দেশে বিনিয়োগ করতে হবে, যেখান থেকে অর্জিত মুনাফাসহ অন্যান্য অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। আবার জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলের (ওফাক) যেসব দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে বিনিয়োগ করা যাবে না। এসব তথ্য যাচাই শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে আবেদন পাঠানো হবে গভর্নরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের কমিটিতে। এই কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক। সদস্য হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধি থাকবেন। এ কমিটি কোনো প্রস্তাব অনুমোদন করলে তার কপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠাতে হবে।

অনুমোদন দেওয়ার পর কেউ হয়তো বাইরে অর্থ নিয়ে গেলেন। তবে কোনো কারণে বিনিয়োগ সম্ভব হলো না, এ ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে ওই অর্থ দেশে ফেরত আনতে হবে। বিদেশে বিনিয়োগের জন্য পাঠানো অর্থ থেকে অর্জিত মুনাফা, লভ্যাংশ ও সুদ ৩০ দিনের মধ্যে দেশে আনতে হবে। শেয়ার বিক্রির অর্থ, বিনিয়োগ বিলুপ্তির ফলে অবশিষ্ট অর্থ, বেতন, রয়্যালটি, কারিগরি জ্ঞান ফি, কমিশন, পরামর্শ ফি, বাজারজাতকরণ ফি ইত্যাদিও দেশে আনতে হবে। কেউ যথাসময়ে না আনলে তাকে মানি লন্ডারিং আইনে বিচারের মুখে পড়তে হবে। বিদেশে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বছর শেষ হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠাতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক টার্নওভার, মুনাফার মার্জিন, কর, প্রযুক্তিগত, সামাজিক, আর্থিক, প্রবিধানিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন খরচ, বাজার অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে একটি ব্যবসায়িক প্রতিবেদন দিতে হবে। এসব তথ্য ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরিদর্শনে যেতে পারবে।

বাংলাদেশে যেহেতু ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট বা মূলধনী হিসাব এখনো কনভার্টেবল বা রূপান্তরযোগ্য নয়, সে ক্ষেত্রে আগেই যেমন বলেছি, এই বিধিমালা অবশ্যই বেশ সুবিধা এনে দেবে। বাংলাদেশে উপযুক্ত ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন বৈধভাবে বিদেশে পাঠাতে পারলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংস্থাগুলোও এতে অনেক বেশি আস্থা পাবে। আমাদের জানা আছে, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু অতীতে সহজে বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারত না, বাজারসুবিধা বা বিশেষ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পগুলো যখন বিদেশি ক্রেতাদের উৎসাহে অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধাজনক দেশে বিনিয়োগ করতে চাইত, বিশ্বব্যাংকের ব্যক্তিখাতের অর্থায়নকারী বা সমমানের সংস্থাগুলো চাইলেও তাদের অর্থায়ন করতে পারত না। এ ক্ষেত্রেও নতুন বিধিমালা সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। তবে বাজার তথা প্রতিযোগী দেশগুলোয় ব্যবসায় পরিবেশের সংস্কারের দিকে আমাদের সব সময়ই চোখ রেখে নীতিমালায়ও দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার আর বাজার উন্নয়নকে হাতে হাত রেখেই এগোতে হবে।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক