সমাবেশে ইমরান খান তাঁর পকেট থেকে একটি কাগজ বের করেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর হাতে ধরা কাগজটি একটি দেশের হুমকি দেওয়া ‘চিঠি’।
সমাবেশে ইমরান খান তাঁর পকেট থেকে একটি কাগজ বের করেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর হাতে ধরা কাগজটি একটি দেশের হুমকি দেওয়া ‘চিঠি’।

মতামত

বিদেশি হস্তক্ষেপ ও পাকিস্তানের রাজনীতির সত্যিকারের ট্র্যাজেডি

অনাস্থা ভোটের ঠিক আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটি রাজনৈতিক সমাবেশে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি স্বাধীন, মুক্ত ও আত্মমর্যাদাশীল জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইমরান খান তাঁর ভাষণে খুব সতর্কতার সঙ্গে আলংকারিক শব্দ ব্যবহার করে জাতির প্রতিষ্ঠাতার সেই মূল্যবোধকে সামনে নিয়ে আসেন। সমাবেশে ইমরান খান তাঁর পকেট থেকে একটি কাগজ বের করেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর হাতে ধরা কাগজটি এমন একটি দেশের ‘চিঠি’, যে দেশটির উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে।

চিঠিতে ইমরান খান ও পাকিস্তানের জন্য যুগপৎ হুমকির বার্তা ছিল বলে প্রকাশ পেয়েছে। ইমরান খান যদি ক্ষমতা থেকে সরে না যান, তাহলে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হবে এবং পাকিস্তানকে এর জন্য ‘দুর্ভোগ’ পোহাতে হবে। ইমরান খান মনে করেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর আগমুহূর্তে তিনি মস্কোতে যে কূটনৈতিক সফরে যান, তারই প্রতিক্রিয়ায় এই হুমকি।

পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি এ ঘটনায় শক্ত নিন্দা জানিয়েছে। এ ধরনের যোগাযোগকে অকূটনৈতিকসুলভ বলে অভিহিত করে তারা জানায়, এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিদেশি এই হস্তক্ষেপের দাবি বিপরীত দাবির স্রোতে (ইমরান খান সরকার পতনের আগে খড়কুটোর মতো বিদেশি হস্তক্ষেপের তত্ত্ব আঁকড়ে ধরেছেন) ডুবে যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক আইন কী বলছে, সেটা জানা জরুরি।

জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের যে গুরুত্ব, সে সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট কোনো বিধি নেই। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও বিদেশ নীতি এর মৌলিক ভিত্তি। জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক এই ফোরামে সদস্যরাষ্ট্রগুলো যুক্ত রয়েছে। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো একটি রাষ্ট্রের সীমানাগত অখণ্ডতা অথবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর বিদেশি রাষ্ট্রের হুমকি বা বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটলে সব সদস্যরাষ্ট্রই তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন করে সাজাতে পারবে।’ ২(৭) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ‘কোনো একটি রাষ্ট্রের আবশ্যকীয় অভ্যন্তরীণ আইনি বিষয়ে’ আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে।

পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সঙ্গে অধীনস্থ সম্পর্কে আবদ্ধ। ইমরান খানের জন্য যেটা সব সময়ই ছিল কাঁটার মতো। একসময় তিনি তড়িঘড়ি করে সেই কাঁটা অপসারণ করতে গেলেন, কিন্তু এতে কী ভয়ানক পরিস্থিতির মুখে তাকে পড়তে হতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁর ছিল না। তাঁর সরকারের পতনের মধ্যে সত্যিকারের ট্র্যাজেডি খোঁজা বোকামি হবে। যে প্রক্রিয়ায় ইমরান সরকারের পতন হলো, সেখানেই এটা নিহিত। আরও একবার পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুব নগ্নভাবেই বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটতে দেওয়া হলো।

১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত নিকারাগুয়ায় সরকার পরিবর্তন সম্পৃক্ততার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক আদালত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপযোগ্য নয়, এমন বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়। আদালত সিদ্ধান্ত দেয়, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আরেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যেমন ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় এবং বিদেশ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে’ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথম বিশদভাবে এ ধরনের নীতির প্রয়োগ হয়েছিল ১৯৪৯ সালে যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার করফু চ্যানেল মামলায়। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম ভয়ানক সশস্ত্র সংঘাতের বিচার করতে গিয়ে এই নীতি প্রয়োগ করেছিল। সেটা ছিল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও উগান্ডার মধ্যকার মামলা। আদালত রায় ঘোষণার সময় সুস্পষ্টভাবে নিকারাগুয়া মামলার রায়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছিল, ‘সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে, সশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটা রাষ্ট্রের আরেকটি রাষ্ট্রের বিরোধী পক্ষকে সমর্থন করা’ হস্তক্ষেপযোগ্য নয় নীতির পরিপন্থী।

ইমরান সরকারের পতনের মধ্যে সত্যিকারের ট্র্যাজেডি খোঁজা বোকামি হবে। যে প্রক্রিয়ায় ইমরান সরকারের পতন হলো, সেখানেই এটা নিহিত

এরপরও কিছু পশ্চিমা দেশ অন্য কোনো দেশে হস্তক্ষেপ এবং সেই দেশের সরকার পরিবর্তন করে। এ কাজকে তারা মহৎ বলে ন্যায্যতাও দেয়। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাত থেকে রক্ষার নামে লিবিয়াতে তারা সেটা করেছে এবং সিরিয়াতে সেটা করার চেষ্টা করেছে। বেশির ভাগ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ‘শান্তির জন্য হুমকি’ স্বরূপ কোনো সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ সনদের ২(৭) অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে।
আমরা বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির অগ্রসরতা, কূটনৈতিক নৈকট্য ও গণমাধ্যমের সার্বক্ষণিক নজরদারির যুগে বাস করছি। এ যুগে নিকারাগুয়ার মতো ঘটনা ঘটানো (এক রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ) মোটেও সহজ নয়। একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে সরানোর হুমকি দেওয়া জাতিসংঘ সনদ এবং অন্যান্য প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও বিধির লঙ্ঘন।

অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত রাশিয়ার বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে ‘২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনৈক্য’ সৃষ্টির অভিযোগে বিচার করেছিল। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার ওই ‘হস্তক্ষেপ’কে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের গণতন্ত্রের ওপর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করলেও একই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আবার প্রত্যাশা করে পাকিস্তান তাদের সার্বভৌম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপস করুক। পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের মাপকাঠিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়ে পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিক।

একটি স্বাধীন বিদেশ নীতি যেকোনো সার্বভৌম রাজনৈতিক সরকারের স্মারকচিহ্ন। পাকিস্তান সুনির্দিষ্টভাবে খুব সরাসরি স্বাধীন বিদেশ নীতির চর্চার চেষ্টা করেছে। বর্তমানে পাকিস্তান একটি জটিল ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে রয়েছে। আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর সঙ্গী হয়েছিল পাকিস্তান। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি জটিল কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তুলেছে। পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সঙ্গে পাকিস্তান এখন আরও গভীর সম্পর্কে জড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক প্রশমনের মতো ভয়ংকর কঠিন কাজটাও তাদের করতে হচ্ছে।

পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সঙ্গে অধীনস্থ সম্পর্কে আবদ্ধ। ইমরান খানের জন্য যেটা সব সময়ই ছিল কাঁটার মতো। একসময় তিনি তড়িঘড়ি করে সেই কাঁটা অপসারণ করতে গেলেন, কিন্তু এতে কী ভয়ানক পরিস্থিতির মুখে তাকে পড়তে হতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁর ছিল না। তাঁর সরকারের পতনের মধ্যে সত্যিকারের ট্র্যাজেডি খোঁজা বোকামি হবে। যে প্রক্রিয়ায় ইমরান সরকারের পতন হলো, সেখানেই এটা নিহিত। আরও একবার পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুব নগ্নভাবেই বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটতে দেওয়া হলো।

সিকানদার আহমেদ শাহ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক আইন উপদেষ্টা এবং ল্যাম্পস ল স্কুলের ফ্যাকাল্টি

দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত