রাজনৈতিক প্রহসনটা আরও অনেক দূর গড়াবে বলে মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বিষয়টাকে ‘ভালো ও মন্দের’ মধ্যকার সংগ্রাম বলে দাবি করেছেন। সম্মিলিত বিরোধী জোট দাবি করেছে, এটা গণতন্ত্রের সংগ্রাম। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা ভিন্ন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী ও ভাগ্যান্বেষীদের একটা উন্মুক্ত খেলা চলছে। এটা ক্ষমতার পঙ্কিল লড়াই। বিকল্প কিছু না থাকায় আমরা সবাই এর ভুক্তভোগী।
জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের আগে রাজনৈতিক ‘ছলনা ও ষড়যন্ত্র’ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি এখন প্রতি ঘণ্টায় বদল হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে কে জিতবে, কে হারবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ফলাফল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দলত্যাগীদের সাংসদ পদে থাকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ওপরও পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, সেটা অনেকখানি নির্ভর করছে।
সব খেলা শেষ হয়ে গেছে, এ রকমটা সবাই যখন ভাবছিলেন, তখনই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-কিউ) সমর্থন তিনি আদায় করে নিয়েছেন। দলটির প্রধান পারভেজ এলাহির জন্য পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদটি লোভনীয়। এর আগে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল তারা পিএমএল-কিউর সঙ্গে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে এবং পারভেজ এলাহিকে তারা মুখ্যমন্ত্রী করবে। হঠাৎ করে পিএমএল-কিউর অবস্থান পরিবর্তন সবার মধ্যেই কৌতূহল তৈরি করেছে।
পিএমএল-কিউর কৌশলী নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ থেকেই ইমরান খানের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিরোধী জোট পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের বিরুদ্ধে যে অনাস্থা ভোট এনেছে, তাতেই চলমান রাজনৈতিক নাটক আরও জমে উঠেছে। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফকে (পিটিআই) অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন ইসলামাবাদ ও লাহোর দুই জায়গাতেই লড়তে হচ্ছে। এ লড়াইয়ের ফলাফলও একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। জাতীয় পরিষদে এক সপ্তাহের মধ্যে যে অনাস্থা ভোট হতে যাচ্ছে, পাঞ্জাবের রাজনীতির সরাসরি প্রভাব সেখানে পড়বে। তবে এখন একটা বিষয় পরিষ্কার যে পিটিআই সরকারকে রক্ষার ইমরান খান যেকোনো ধরনের আপস করতে রাজি।
চলমান রাজনৈতিক লড়াইটা এখন শুধু জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সীমাবদ্ধ নেই। ইমরান খান সেটা জনগণের মধ্যে নিয়ে গেছেন। অন্য জনতুষ্টিবাদী নেতাদের মতোই ইমরান খান নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের হাতে ক্ষমতা হারানোর মুখে ধর্ম ও জাতীয়তার কার্ড খেলতে শুরু করেছেন। ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করে তিনি তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। ভালো ও মন্দের মধ্যকার লড়াই হিসেবে সংকটটাকে উপস্থাপন করছেন।
বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ছলনা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ ইমরান করে আসছেন, সেই একই কাজে তিনিও লিপ্ত। তাঁর ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারটি যত নড়বড়ে হয়েছে, ততই তিনি তাঁর নিজের বলা ‘নৈতিকতার উঁচু ভূমি’ থেকে পিছল খেয়েছেন। সর্বশেষ পিএমএল-কিউর সঙ্গে পিটিআই যে সন্ধি করেছে, সেটা রাজনৈতিক শঠতার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। এটা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত।
পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলে বিরোধীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইমরান খান পিএমএল-কিউর দাবি মেনে নিয়ে বুজদারকে পদত্যাগ করান। বুজদারের এ পদত্যাগ প্রাদেশিক পরিষদে ভোটাভুটির মাধ্যমে পদ হারানোর অসম্মান থেকে তাঁকে রক্ষা করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে পাঞ্জাবের শাসনক্ষমতা থেকে পিটিআইকে সরে যেতে হচ্ছে। দলের মধ্যে বিরোধিতা সত্ত্বেও উসমান বুজদারকে বিদায় করেছেন ইমরান। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক হাওয়া বদলের ইঙ্গিত মিলছে। ডিজে খান শহর থেকে উঠে আসা একেবারে অপরিচিত বুজদারের দেশের রাজনীতির শীর্ষে আহরণ পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের একটা প্রধান উত্তেজনাকর বিষয় ছিল।
পিএমএল-কিউর সঙ্গে এ আপস পিটিআইয়ের মধ্যে বিভক্তি বাড়াবে। এটা এখনো নিশ্চিত নয়, নানা নেতৃত্বে বিভক্ত পিটিআইয়ের সাংসদেরা পারভেজ এলাহিকে ভোট দেবেন কি না। আবার পারভেজ এলাহি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদেশ পাঞ্জাবে পিটিআইয়ের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
চলমান রাজনৈতিক লড়াইটা এখন শুধু জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সীমাবদ্ধ নেই। ইমরান খান সেটা জনগণের মধ্যে নিয়ে গেছেন। অন্য জনতুষ্টিবাদী নেতাদের মতোই ইমরান খান নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের হাতে ক্ষমতা হারানোর মুখে ধর্ম ও জাতীয়তার কার্ড খেলতে শুরু করেছেন। ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করে তিনি তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। ভালো ও মন্দের মধ্যকার লড়াই হিসেবে সংকটটাকে উপস্থাপন করছেন।
সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে ইমরান খান দাবি করেছেন, তাঁকে সরানোর জন্য বিদেশি চক্রান্ত চলছে। গত সপ্তাহে ইসলামাবাদে একটি সমাবেশে একটি কাগজ নাড়িয়ে তিনি দাবি করেন, সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য বিদেশি অর্থায়নে চক্রান্ত চলছে, এটা তারই প্রমাণ। তিনি দাবি করেন, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের জন্য তঁাকে এ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই কাগজের উৎস সম্পর্কে কিছুই বলেননি ইমরান।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ খুবই গুরুতর একটা অভিযোগ। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও নিরাপত্তা ফোরামে উত্থাপন না করে, ইমরান সেটাকে জনগণের ইস্যুতে পরিণত করেছেন। এর ফলে তাঁর দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ ধরনের তুরুপের তাস পরিস্থিতি থেকে ইমরান খানকে উদ্ধার করতে পারবে বলে মনে হয় না।
দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● জাহিদ হোসেন পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক