সিডনি শ্যানবার্গের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ১৯৯৪ সালে। মুক্তিযোদ্ধা-লেখক মফিদুল হক তাঁর প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ওপর নিউইয়র্ক টাইমস-এ সিডনি শ্যানবার্গের লেখা বিভিন্ন প্রতিবেদন নিয়ে একটি গ্রন্থের পরিকল্পনা করেছিলেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর সম্মতি আদায় ও একটি ভূমিকা সংগ্রহ করার। শ্যানবার্গ সে সময় নিউইয়র্ক টাইমস ছেড়ে নিউইয়র্ক নিউজডে পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। আমার অনুরোধ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, কোনো অতিরিক্ত অনুসন্ধান ছাড়াই, তিনি সম্মতি জানিয়েছিলেন। একটি চমৎকার ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন।
তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ পরের বছর, সে বইয়ের কপি পৌঁছে দেওয়ার সময়। ম্যানহাটনের একটি রেস্তোরাঁয় আমরা বসেছিলাম, বইটি তাঁর হাতে তুলে দিতেই গভীর আগ্রহে তুলে নিলেন, যেন খুব প্রিয়, খুব ঘনিষ্ঠ স্মৃতির অ্যালবাম তিনি পেয়েছেন। সে বইয়ের প্রচ্ছদে কয়েকবার আলতোভাবে হাত বোলালেন। ‘আহ্, তাহলে এই সেই বই!’ স্বগত স্বরে বললেন।
সেদিন বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর একটি আত্মিক সম্পর্কের কথা বলেছিলেন শ্যানবার্গ। ১৯৭০-এর গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর দিল্লি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকায় তাঁকে অনেকবার যেতে হয়েছে। সত্তরের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করেছেন, সে বছর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় দেখেছেন, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর-কষাকষি কাছ থেকে দেখেছেন, সেই সূত্রে এই বাঙালি নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে তুলেছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তার অন্যতম। ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্সে যেদিন জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, সেদিনও শ্যানবার্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
একাত্তরের ১০ মাস শ্যানবার্গ অসংখ্য প্রতিবেদন লিখেছেন, কোনোটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে, কোনোটি দিল্লি বা কলকাতা থেকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে উদ্বাস্তু শিবিরে বহুবার গিয়েছেন, উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অবর্ণনীয় দুর্দশার বিবরণ বহু যত্নে তুলে ধরেছেন। সাহিত্য প্রকাশের ডেটলাইন বাংলাদেশ গ্রন্থে সেসব প্রতিবেদনের একটি সুনির্বাচিত সংকলন পত্রস্থ হয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক, অথচ এই যুদ্ধে তাঁর অবস্থান কোথায়, প্রতিটি প্রতিবেদনে সে কথা স্পষ্ট। জুন মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ঠিক করে পুরো দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে, সে কথা প্রমাণের জন্য কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে তাদের প্রহরায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবে। শ্যানবার্গও ছিলেন তাঁদের একজন। সে সফর শেষে নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত তাঁর প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিকার গণহত্যার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্যানবার্গের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম একাত্তরের কোন স্মৃতিটি তাঁর মনে সবচেয়ে প্রবল হয়ে আছে। কোনো দ্বিধা না করে জবাব দিয়েছিলেন, শেখ মুজিব। মার্চে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার খবর নিতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। সে যোগাযোগ একসময় বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। শ্যানবার্গ সেদিন এয়ারপোর্টে, তাঁকে দূর থেকে দেখে বঙ্গবন্ধু চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আরে শ্যানবার্গ, তুমি?’ যেন দুই পুরোনো বন্ধু, এমনভাবে তাঁরা সেদিন করমর্দন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুদিন পর ১৮ ডিসেম্বর গিয়েছিলেন মিরপুরের এক গণকবরে। সেখানে তাঁর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলেছিলেন, যার বিবরণ আমার নাগরিক সময় ও প্রাসঙ্গিক চিন্তা গ্রন্থে আমি লিপিবদ্ধ করেছি। ‘মিরপুরের একটি গণকবরে ১২-১৩ বছরের একটি বালকের সঙ্গে তাঁর দেখা। অপুষ্টি ও অভাবে জীর্ণ শরীর। মাটি খুঁড়ে বানানো বেশ প্রশস্ত গণকবরটির চতুর্দিকে ছুটে বেড়াচ্ছিল ছেলেটি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে খেলা করছে, দৌড়ে দৌড়ে ছুটছে, হাতে ছোট একটি খুরপি দিয়ে মাটি খোঁচাচ্ছে। অধিকাংশ কবর সদ্য তৈরি, মাটি তখনো জমাট বাঁধেনি। মাটিতে হাত ডোবালেই বেরিয়ে আসছিল সদ্য মৃত মানুষের দেহাবশেষ। এই ভুতুড়ে জায়গায় এই ছেলেটি কেন, ও এমনই-বা করছে কেন? দোভাষীকে প্রশ্ন করলেন শ্যানবার্গ। খোঁজ নিয়ে দোভাষী জানালেন, বাবার লাশ খুঁজছে ছেলেটি। “সেই ছেলেটিকে আমি এখনো দেখতে পাই, চোখ বুজলেই তার মুখটা ভেসে ওঠে,” শ্যানবার্গ অনুচ্চ স্বরে বলেছিলেন।’
ম্যানহাটনে সেই সাক্ষাতের এক দিন পর আমার অফিসে হঠাৎ একটি প্যাকেট এসে হাজির, পাঠিয়েছেন শ্যানবার্গ। নভেম্বর ১৯৭১-এ ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ওপর নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম পাতায় যে দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপে, সেটি বাঁধাই করে পাঠিয়েছেন তিনি। সঙ্গে সাদা কাগজে নিজ হাতে লেখা, ‘বন্ধুত্ব ও কৃতজ্ঞতাসহ’। এরপর আরও অনেকবার শ্যানবার্গের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেন্টু রায় একাত্তরের গণহত্যার বিচার নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। অনুরোধ করা মাত্রই বন্ধু তারিক মাহবুবের ট্র্যাভেল এজেন্সি অফিসে এসে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছিলেন শ্যানবার্গ। বলেছিলেন, একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে যদি সাহায্য দরকার হয়, নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ নিয়ে সাক্ষী হতে তিনি প্রস্তুত।
জীবনের শেষ ১০ বছর নানা রোগশোকে ভুগছিলেন শ্যানবার্গ। কোলাহল এড়াতে ও দ্রুত নিরাময়ের আশায় ম্যানহাটনের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে যান শহর থেকে দূরে। ই-মেইল ও টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। নিউইয়র্কে বাঙালিদের বার্ষিক বইমেলায় অতিথি হওয়ার জন্য তাঁকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি। তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়েছেন, যদিও অসুস্থতার কারণে একবারও আসতে পারেননি। তরুণ চিত্রপরিচালক অনিন্দ্য আতিক একাত্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। শ্যানবার্গের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তিনি রাজি; কিন্তু অসুস্থতার কারণে সে সাক্ষাৎকারও তাঁর দেওয়া হয়নি।
তাঁর কাছ থেকে শেষ ই-মেইলটি আমি পাই ২০১২ সালের ১০ মে। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতা আমার জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একাত্তরের গণহত্যা ভালোভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি, সে জন্য আমি সে ঘটনা যতটা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ আমার নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার জন্য তাঁকে সম্মান করি। ১৯৭১-এ আমার সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপরাধমূলক ব্যবহারের প্রতি যে সমর্থন দেয়, সে জন্য আমি ঘৃণা বোধ করি। তুমি হয়তো জানো, আমার ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস-এ আমি সে সময়ের ১২টি প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করেছি।
‘খুব খুশি হতাম যদি এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেত। কিন্তু এখন আমাকে অবশিষ্ট জীবন ধীরগতিতে কাটাতে হবে। আমি কখনোই বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতার কথা ভুলব না, সে সময় তোমার দেশের মানুষ যে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে গেছে, তা-ও কখনো ভুলব না।’
৯ জুলাই, ৮২ বছর বয়সে বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিদায়, শ্যানবার্গ! বাংলাদেশও তোমাকে কখনো ভুলবে না।
১৬ জুলাই ২০১৬, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।