>১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের মুহূর্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা সংকলিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, ভোরের কাগজ পত্রিকার বিজয় দিবসের ক্রোড়পত্রে। সেই লেখাগুলো নিয়ে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ শিরোনামের একটি বই। এবার বিজয়ের মাসে আমরা বইটি থেকে কিছু নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করছি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য। আজ ছাপা হলো জাহানারা ইমাম–এর লেখাটি।
একাত্তরের বিজয় মুহূর্ত? তখন আমি কি আর আমাতে ছিলাম? বিজয় অর্জনের মাত্র তিন দিন আগে আমার স্বামী শরীফ আকস্মিক হৃদ্রোগে চিরকালের মতো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যে বিজয় দেখার জন্য সে এত উদ্গ্রীব হয়েছিল, রুমীকে পাক আর্মি তিন মাস আগে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও যে দুঃসহ পুত্রশোক নীরবে মুখ গুঁজে সহ্য করে ঢাকায় বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার যা করণীয় কাজ ছিল, সেগুলো করে গেছে, সেই বিজয় সে দেখে যেতে পারল না। রুমী নেই, শরীফও চলে গেল। ভারতীয় বিমানের রকেটিং ও স্ট্রেফিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে শরীফের জানাজা ও দাফন হলো। ছোট ছেলে জামী ক্ষিপ্তের মতো মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে, ‘আমার আর যুদ্ধ করা হলো না। আমি ওদের দেখে নেব। ওরা ভাইয়াকে খুন করেছে, আব্বুকেও খুন করেছে, ওদের ছেড়ে দেব না।’ জামীকে সামলানোই তখন এক সমস্যা। তার বন্ধু আলী, আমার মা, বোন—কেউই তাকে শান্ত করতে পারছে না। আমি তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে রেখেছি। যাতে সে ছিটকে বাইরে যেতে না পারে।
ওদিকে আরেক বিপদ। ভারতীয় বিমানের বোমাবর্ষণে আমার সামনের কয়েকজন প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদে বোমা পড়েছে (সেই সময় প্লেনের শব্দ শুনলেই লোকজন ছাদে উঠে যেত দেখার জন্য), তাতে এক বাসার দুটি মেয়ে মারা গেছে, বেশ কয়েকজন জখম, তারাসহ আশপাশের তিন-চারটি বাড়ির সবাই এসে আশ্রয় নিয়েছে আমাদের বাড়িতে। গুরুতর আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে সেকি সবার খাওয়াদাওয়া, রাতে সবার শোয়ার ব্যবস্থা—এসব করতে হচ্ছিল। এর মধ্যেই সারা দিন ধরে বোমাবর্ষণ বাড়া-কমার ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য আত্মীয়-বন্ধু দেখা করতে এসেছেন, কান্না ও হাহাকারের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়েছেন, আর বেশি দেরি নেই, শিগগিরই ঢাকার পতন হলো বলে। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা
এগিয়ে এসে ঢাকা প্রায় ঘিরে ফেলেছেন। শরীফও তো মরার আগের কয়েক দিন ধরে এ কথাই বলত। ১৫ ডিসেম্বর সারা দিন কলকাতা রেডিও খোলা ছিল, বারবার শোনা যাচ্ছিল পাক আর্মিকে সারেন্ডার করার নির্দেশ। সে জন্য বিকেল চারটা থেকে পরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত বোমাবর্ষণ বন্ধ থাকবে, বলা হচ্ছিল।
পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের সকালে কলকাতা রেডিওতে আবার ঘোষণা শোনা গেল, যুদ্ধবিরতি বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সকাল থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব স্রোতের মতো হু হু করে আসছে। সবার মুখেই এক কথা—আজ বিকেলে পাক আর্মি আত্মসমর্পণ করবে। পাকসেনারা, বিহারিরা যে যেদিকে পারছে, পালাচ্ছে। লোকজন কারফিউ উপেক্ষা করে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। হায়! আমি বেরোতে পারছি না। শোকে এবং আলসারের ব্যথায় শয্যাশায়ী। জামী বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে, সে কয়েকটি খানসেনা মারবেই মারবে। আমি বিছানায় পড়ে থেকেও তার হাত কঠিন মুষ্টিতে ধরে আছি। আলীকে বলেছি, খবরদার, ওকে বেরোতে দিবি না।
শরীফের বন্ধু মঞ্জুর হোসেন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে এবং গাড়ির ভেতরের সিটে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে যখন এলেন এবং বললেন বিকেল তিনটায় পাক আর্মি সারেন্ডার করবে, তখন স্থির বিশ্বাস হলো—আজই তাহলে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের দিন, আর আজই হবে বাংলাদেশের মুক্তিপাগল জনগণের বিজয়ের দিন। মঞ্জুর যাওয়ার সময় পতাকাটা আমার কাছে রেখে বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।’
ঘরের মধ্য থেকেও বুঝতে পারছিলাম বাইরে সারা ঢাকা শহরে কী তুমুল উত্তেজনা। শুনছি মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকছেন চারদিক থেকে, ঢুকছেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা। খানিক পরপরই পরিচিতরা ৫ মিনিটের জন্য ঢুকে প্রথমে খানিকটা কান্না ও হাহাকার, তারপরেই আনন্দের সংবাদ—মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে উল্লাস করছেন, ভারতীয় জেনারেলদের জিপ ঘিরে বাংলাদেশি জনতা ফুল ছুড়ে দিচ্ছে। কেউ আর ঘরে নেই। আমিই শুধু রইনু পড়ে। শোকে, দুঃখে, ক্রোধে, অপমানে ক্ষিপ্ত পুত্র, তাকে আগলে রাখা বন্ধু, আমার মা, বোন, ননদ, ভাগনিরা আর আমার অন্ধ, বৃদ্ধ অথর্ব শ্বশুর—এই কজন শুধু আমায় ঘিরে রইল। আর রইল এ বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এক দঙ্গল প্রতিবেশী। আজ এই ১৬ ডিসেম্বরে পাক আর্মির সারেন্ডারের দিনে, বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে তারা ঘরে বসে শরীফের কুলখানির সোয়ালক্ষ দোয়া পড়ল, মেয়েরা ঘরে জমানো চাল, চিনি, জাফরান দিয়ে জর্দা রাঁধল, সবাই মিলে শরীফের রুহের মাগফিরাত কামনা করল।
একাত্তরের সেই বিজয় দিবসে আমার অনুভূতি-উপলব্ধির কথা আমি কখনোই অন্যদের মতো গুছিয়ে, জুতসই শব্দাবলি সাজিয়ে লিখতে পারব না। মনে হয়, মনটা সেদিন পাথর হয়ে গিয়েছিল এবং যান্ত্রিকও। রোবটের মতোই অনুভূতিহীন মন নিয়ে সবকিছুর তদারক করেছি। ১৭ ডিসেম্বর মঞ্জুর এসে পতাকা তুলেছেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও এসেছে, সবাই কেঁদেছে, আমি কাঁদতে পারিনি। ফ্যাল ফ্যাল করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। বিরাট একটা শূন্যতার মধ্যে যেন বোধশূন্যহীন হয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার পর যখন রুমীর কয়েকজন সহযোদ্ধা ২ নম্বর সেক্টরের মেলাঘর ক্যাম্পের দুর্ধর্ষ বীর মেজর হায়দারের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এল আমার সঙ্গে দেখা করতে, কেবল তখনই যেন প্রাণ পেয়ে আমি জেগে উঠলাম। ওদের হাত ধরে ঘরের মাঝখানে টেনে এনে বললাম, ‘এসো বাবারা, বসো।’
জাহানারা ইমাম: (১৯২৯-১৯৯৪) শহীদজননী, লেখক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন