বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দারুণ উৎকর্ষ অর্জন করেছে। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। আর হবেই না বা কেন, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জেতার পর আমরা তো আর পেছনে ফিরে তাকাইনি, এগিয়েছি সামনের দিকে। আজ আমরা এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠছি। কাপ জিততে না পারলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শ্রেয়তর দলের কাছে হারছি। বিশ্বকাপ মাতাচ্ছি। আমাদের সাকিব আল হাসান বহুদিন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের কাতারে আছেন।
আজ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসর বসা মানে গ্যালারিতে ভিভিআইপিদের উপস্থিত থাকা। তাঁরা সবাই ক্রিকেট খেলেছেন কি না জানি না, কিন্তু খেলার দিন মাঠে থাকেন। এতে বোঝা যায়, ক্রিকেট খেলা আজ আমাদের জাতির পরিচয় হয়ে উঠেছে।
ক্রিকেট যে আজকের অবস্থায় এসেছে, তার পেছনে সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে পাড়া-মহল্লার ক্রীড়ানুরাগী মানুষের ভূমিকা আছে। অন্য কথায় বললে, ওই সময় আমাদের সমাজে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল খেলাধুলা। আজকের মতো তখন টেলিভিশনের এত প্রসার ছিল না। আর ইন্টারনেটের নাম তো তখন মানুষ শোনেইনি। টেলিভিশন ছিল, কিন্তু চ্যানেল ছিল মাত্র একটি—বিটিভি। তার প্রচার সময়ও ছিল নির্দিষ্ট। ফলে আজকের প্রজন্ম হয়তো সেই সময়টা ঠিক ঠাহর করতে পারবে না।
যা হোক, তখন বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন খেলাধুলা হতো। এই যেমন গ্রীষ্মের সময় ফুটবল, ভলিবল, টেবিল টেনিস, হাডুডু প্রভৃতি, শীতের সময় ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন। এমনকি কোথাও কোথাও হকি খেলাও হতো। একটা কথা না বললেই নয়, তখন সব খেলারই কয়েকজন তারকা ছিলেন, মানুষ যাদের একনামে চিনত। হকির জুম্মন লুসাই, টেবিল টেনিসের জোবেরা রহমান লিনু, ফুটবলের সালাহ্উদ্দিন, কায়সার হামিদ, ক্রিকেটের মিনহাজুল আবেদীন, গোলাম নওশের প্রিন্স প্রমুখ। এঁদের সবারই তখন তারকা খ্যাতি ছিল। আবাহনী-মোহামেডন ফুটবল ম্যাচের দিন তো দেশ দুই ভাগ হয়ে যেত। দুই দলের সমর্থকেরা খেলার দিন আর কিছু করতেন বলে মনে পড়ে না।
যা নিতান্ত না করলেই নয়, তা ছাড়া অন্য কিছু করতেন না কেউ। তাঁদের মধ্যে যে উত্তেজনা থাকত, তা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। তখন বাংলাদেশ ফুটবল দলের আন্তর্জাতিক সাফল্য হয়তো ছিল না, কিন্তু ঘরোয়া ফুটবলের উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। খুব ভালো মানের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় নিজেদের ক্রীড়াশৈলী দিয়েই দর্শকদের মাঠে টেনে আনতেন। তাঁদের তারকাখ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক বিদেশি কোচ অটো ফিস্টার তো একবার মোনেম মুন্নাকে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মোনেম মুন্নার ভুল দেশে জন্ম হয়েছে। আবার ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সাফ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলীদের নিয়ে গঠিত ভারতীয় ‘এ’ দলকে হারিয়ে দিয়েছিল।
জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও তখন অনেক খেলা হতো। আসলে স্থানীয় পর্যায়ে খেলা হতো বলেই জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড়ের অভাব হতো না। আমাদের ক্রিকেটও সেই ধারাবাহিকতার ফসল। এ ছাড়া জেলা ফুটবল, ক্রিকেট লিগ তো হতোই, পাড়া পর্যায়েও লিগ হতো। আমি নিজেই দেখেছি, ছোট বেলায় টাঙ্গাইলের আকুর টাকুর পাড়ায় ‘খাসি কাপ’ ফুটবল ম্যাচ হতো। সেটা ছিল এক ম্যাচের টুর্নামেন্ট। যেখানে বিজয়ী দলকে বিজিতরা খাসি উপহার দিত, এরপর সেই খাসি দিয়ে পিকনিক হতো, পাড়ার আরও অনেকেই এতে অংশ নিতেন। বিজয়ীরা কাপ নিয়ে মিছিল করতেন। সেদিন পাড়ায় থাকত উৎসব উৎসব ভাব। প্রতি শীতে ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হতো। আবার এই খেলা নিয়ে মারামারিও হতো।
তখন খেলাটা স্রেফ নৈপুণ্যের ব্যাপার ছিল না, আবেগের ব্যাপারও ছিল। বহু মানুষ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো খেলা নিয়েই পড়ে থাকতেন। আমি নিজে ক্রিকেট খেলতাম, আমার কোচ ছিলেন নজরুল ইসলাম খান নামের পাকিস্তান আমলের বিখ্যাত একজন খেলোয়াড়। তিনি নিজের সরঞ্জাম দিয়ে আমাকে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দিতেন। কিন্তু আজ মহল্লায় গেলে সেই পরিবেশ আর পাই না। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।
আজ ক্রিকেটে আমরা উৎকর্ষ অর্জন করেছি ঠিকই, কিন্তু অন্য খেলা একরকম হারিয়ে গেছে। সে দিকে আমাদের নজর নেই। একই সঙ্গে, খেলার ভেতরকার প্রাণটাই যেন হারিয়ে গেছে। এটা হয়ে গেছে স্রেফ নৈপুণ্য ও ব্যবসার ব্যাপার। পাড়া-মহল্লায় মানুষ এখন আর আনন্দ নিয়ে মাঠে খেলতে বা খেলা দেখতে যায় না। যারা খেলে, তারা এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েই খেলে। আর যারা খেলে না, তারা একবারেই খেলে না। খেলার সঙ্গে প্রাণের যোগটা আর নেই। এই প্রজন্মের বিনোদন হচ্ছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট। তারা খেলার মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটার সামাজিক কুফল কিন্তু দিনকে দিন বাড়ছে, আমরা কি সেটা ভেবে দেখছি?