আজ অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের ৮০তম জন্মোৎসব করতে যাচ্ছে ‘জন্মদিন উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর শহরে তাঁর জন্ম। তিনি মহারাজা গিরিজা নাথ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৫১ সালে। এরপর তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন প্রথম শ্রেণিতে। অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন যথাক্রমে ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে। ১৯৬২ সালে কুমিল্লার অ্যাডভোকেট শশীভূষণ রায়ের কন্যা শেফালী রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে অজয় রায় বিলেতে উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ফিজিকস ফ্যাকাল্টিতে। এখানে ‘কঠিনাবস্থায় বিকিরণ রসায়ন’ নিয়ে তিন-চার বছর কাজ করেন। গবেষণাপদ্ধতি হিসেবে ইলেকট্রন স্পিন অনুনাদ বর্ণালিবীক্ষণ ও মাইক্রোতরঙ্গ বর্ণালিবীক্ষণ ব্যবহার করেন। এ জন্য ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ডক্টর অব ফিলোসফি’ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৮ সালের শেষে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসেবে পুনরায় যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে ইউনেসকোর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত কঠিনাবস্থার পদার্থবিদ্যা ও ক্রিস্টালোগ্রাফির একটি অগ্রসরমাণ কেন্দ্র স্থাপনে তিনি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। এটি ১০ বছর টিকে ছিল এবং ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকজন নামকরা বিজ্ঞানীসহ বহু বিদেশি ছাত্র, ফেলো, গবেষক এখানে কাজ করেছেন। অধ্যাপক রায়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা প্রগ্রেস অব এনএমআর স্পেকট্রোস্কোপিতে উল্লেখিত আছে।
অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অবসর নেন ২০০০ সালে; এরপর তিনি ইউজিসির অধ্যাপক পদে বরিত হন। তবে তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার জন্য। তিনি বাংলা ত্রৈমাসিক মুক্তান্বেষা ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক। মুক্ত চিন্তক ও যুক্তিবাদী বর্তমান প্রজন্ম উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত ইন্টারনেট ফোরাম ‘মুক্ত-মনা’র অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে এই জনপ্রিয় ওয়েবসাইটটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। পরে দায়িত্ব পান তাঁর বড় সন্তান আইটি বিশেষজ্ঞ বায়োটেকনোলজিস্ট ড. অভিজিৎ রায়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে অভিজিৎকে জঙ্গিবাদী ঘাতকেরা উপর্যুপরি চাপাতির আঘাতে হত্যা করে। অজয় রায় আন্তর্জাতিক যুক্তিবাদী সংগঠন ‘ন্যাশনালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ২০১২ সালে তিনি ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন। অধ্যাপক রায় শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সম্প্রীতি মঞ্চের চেয়ারম্যান; সম্প্রীতি মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
অজয় রায় বিদেশের চেয়ে দেশের মাটিতেই গবেষণাকর্মে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। তাই নিজ কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে বস্তুবিজ্ঞান ও কঠিনাবস্থার পদার্থবিদ্যায় উচ্চতর গবেষণা পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আধুনিক গবেষণাগার গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭২-৭৩ কালপর্বে এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর একাডেমিক গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ৫৪; জনপ্রিয় বিজ্ঞান, শিক্ষা, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, স্থাপত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রবন্ধ আছে সাতটি। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে Concepts of Electricity and Magnetism; Concepts of Electricity and Magnetism; The Proto Bengalis: Anthropological and Sociological Analysis; বাঙালির আত্মপরিচয়: একটি পুরাবৃত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক আলোচনা; বিজ্ঞান ও দর্শন: জড়ের সন্ধানে; আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ; আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ; স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি; বিশ্বাস ও বিজ্ঞান; অতিশাব্দিক বিশ্বায়ন ও মৌলিক পদার্থবিদ্যা; রবীন্দ্রনাথ ও উপনিষদ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি থেকে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিশ্বকোষের অন্যতম সম্পাদক ও লেখক। অধ্যাপক রায় বর্তমানে দুটি জার্নালের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত: জার্নাল অব বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (বিজ্ঞান), মুক্তান্বেষা—একটি ত্রৈমাসিক সৃষ্টিশীল একাডেমিক পত্রিকা। অধুনালুপ্ত দ্য ফিজিসিস্ট-এর সম্পাদক ছিলেন।
অধ্যাপক রায় বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন এবং কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষকদের নিয়ে সংগঠিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির’ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
২০০০ সালে পাকিস্তানি মুক্তচিন্তাবিদ ড. ইউনুস শেখ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে যখন জেলে অন্তরীণ হয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের অপেক্ষায় ছিলেন, তখন অজয় রায় ‘ড. ইউনুস শেখ রক্ষা কমিটি’ গঠন করে তাঁর মুক্তির জন্য ঢাকায় সভা, মিছিল, সেমিনারের আয়োজন করেন। তিনি জেনারেল পারভেজকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইউনুস শেখের প্রাণরক্ষার আবেদন জানিয়ে। এ ছাড়া অনুরূপ চিঠি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও পাঠিয়েছিলেন। ফলে ইউনুস শেখের প্রাণ রক্ষা হয়। ড. শেখ ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক রায়কে চিঠি দিয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানান।
২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দুর্যোগকালে অজয় রায়ের নেতৃত্বে আমরা উৎপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। সে সমেয় গঠিত ‘গণতদন্ত কমিশনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। অধ্যাপক রায় ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে ঢাকায় একটি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র চালু করেন, যাতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি না হয়। তিনি বাংলাদেশের যুক্তিবাদী ও দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা জগতে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁকে নিয়ে বাংলায় ও ইংরেজিতে একাধিক প্রবন্ধও লিখেছেন।
হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিসের সভাপতি অজয় রায় আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক আর মুক্তচিন্তার মানুষ। তিনি যুক্তিবাদী, মিষ্টভাষী, সজ্জন আর বিনয়ী। আমরা চাই রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সংগ্রামে অধ্যাপক রায় আরও অনেক বছর আমাদের মাঝে আলো ছড়াবেন। ‘জয়তু অধ্যাপক রায়।’
রোবায়েত ফেরদৌস: যুগ্ম আহ্বায়ক, ‘অধ্যাপক অজয় রায়ের আশিতম জন্মদিন উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’ এবং সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।