শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলাকে ‘শক্ত নেতৃত্ব না থাকার ফল’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তাকেই নির্বাচনী অস্ত্র বানাচ্ছে বিজেপি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লোকসভা নির্বাচন চলাকালে এ বিষয়কে পুঁজি করে নিজের প্রচারে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তাঁর পাঁচ বছরের শাসনামলে এ ধরনের কোনো হামলা ভারতে হয়নি উল্লেখ করে আবারও ক্ষমতায় আসার যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন মোদি। নির্বাচনে জয় পেতে নিজের ‘যুদ্ধংদেহী’ ভাবমূর্তিটিই তুলে ধরছেন তিনি।
ভারতের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে ১১ এপ্রিল, চলবে আগামী ১৯ মে পর্যন্ত। সাত ধাপের এই নির্বাচন চলাকালেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার উদাহরণ টেনে নিজেকে ভারতের নিরাপত্তার জন্য ‘প্রয়োজনীয়’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলছেন, তাঁর পাঁচ বছরের শাসনামলে এ ধরনের কোনো সন্ত্রাসী হামলা ভারতে হয়নি। কারণ হিসেবে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগমুহূর্তে এক প্রচার সভায় মোদি বলছেন, ‘সন্ত্রাসীরা জানে, মোদির শাসনামলে তারা শাস্তি থেকে পালাতে পারবে না।’ এ ক্ষেত্রে আনছেন কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়া খণ্ডযুদ্ধের প্রসঙ্গও। পাকিস্তানের সীমানায় ঢুকে বিমান হামলার পরও পাকিস্তান কোনো প্রত্যুত্তর না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘পাকিস্তান তাঁকে ভয় পায়।’
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধংদেহী’ ভাবমূর্তি তুলে ধরে এবং ভারতের সামনে সন্ত্রাসের মতো বিপদ অপেক্ষা করছে—এমন চিত্র তুলে ধরে মোদি নিজেকে ‘নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। অবশ্য সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর—এমনটি বলা যাবে না। কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ২০০৮ সালে বোমা হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ থাকা প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে মোদির দল বিজেপি ভোপাল থেকে নির্বাচনের টিকিট দিয়েছে। ওই হামলায় ছয়জন মুসলিম নিহত হয়েছিলেন। এই মনোনয়নের যৌক্তিকতা হিসেবে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন, ‘বিরোধী কংগ্রেস দল, যারা হিন্দুদের অবজ্ঞা করে, তাদের প্রতি এটি একটি প্রতীকী জবাব।’
ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কা, দেশের নিরাপত্তা ইত্যাদিকে যেভাবে অস্ত্র বানিয়ে সফল হয়েছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, মোদি সে পথেই হাঁটছেন। নরেন্দ্র মোদির এই অভিমুখ নিশ্চিতভাবেই শঙ্কায় ফেলছে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে। মূলত, বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সেই পুরোনো খেলাই খেলছেন তিনি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাঁর দলের নেতারা, এমনকি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ‘ধর্মীয় পরিচয়’ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য অনন্তকুমার হেজ সম্প্রতি বলেছেন, ‘মুসলিম বাবা ও খ্রিষ্টান মায়ের সন্তান হয়ে রাহুল কী করে গান্ধী হতে পারেন? একজন ব্রাহ্মণ হতে পারেন।’ যদিও সত্য হচ্ছে, রাহুল গান্ধীর মা একজন ইতালীয় হলেও তাঁর বাবা বা আর কোনো নিকটাত্মীয় মুসলিম নন।
নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির নানা অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা ইত্যাদি ঢাকতেই অনন্তকুমার এই অস্ত্র ব্যবহার করছেন, তা না বললেও চলে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কোটি মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাসসহ বেশ কিছু চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কংগ্রেস আমলের দুর্নীতি ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এখন এই পাঁচ বছর পর তাঁর ও তাঁর দলের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে সেই দুর্নীতির অভিযোগই প্রকট হয়ে উঠেছে। যে মোদি ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই তাঁর আমলেই ভারত দেখল দেশটির স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কৃষক বিক্ষোভ, যাঁরা সেই ‘আচ্ছে দিনের’ দেখা পাননি। তিনি ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নিলেন, তা বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। প্রথম ধাক্কাটি খেলেন তিনি মুদ্রা অবমূল্যায়ন করে, যার ধাক্কা ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখনো সামলে উঠতে পারেননি। এই পদক্ষেপের কারণে শুধু তামিলনাড়ুতেই প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে বলে জানাচ্ছে ফেয়ার অবজারভার। এর ফলে শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই কাজ হারিয়েছেন ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ। একইভাবে পণ্য ও সেবা খাতে কর পুনর্গঠনে গৃহীত পদক্ষেপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতিতে।
ক্ষমতার অপব্যবহারের বিভিন্ন নজির রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হস্তক্ষেপ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দুজন গভর্নরের পদত্যাগে যার প্রমাণ রয়েছে। এবং আরও বড় প্রমাণ রয়েছে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়ায়, যাঁর ডিগ্রি অর্থনীতিতে নয়, ইতিহাসে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মোদির হস্তক্ষেপেই এমনটা ঘটেছে। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, কাশ্মীর আবার অস্থির হয়ে ওঠার পেছনেও বিজেপি সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য ও পদক্ষেপকেই কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে ধারা শুরু হয়েছে ভারতে, তাও এই নরেন্দ্র মোদির আমলেই। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ মাত্রা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে এমনকি সিবিআইও রয়েছে। আর মন্ত্রিসভার কথা তুলতে গেলে এটাই বলতে হয়, ভারতের যেকোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত গত পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপেই এসেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য কোনো সদস্যকে যোগ্যই মনে করেন না বা যোগ্য হয়ে উঠতে দেন না বলে সমালোচনা রয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতেই তিনি এটি করেন বলে মনে করা হয়। আর এসবের মধ্য দিয়ে জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের ওপরও ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ছাড়া কমিশন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ওঠা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এত কিছুর পরও নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী দৌড়ে এখনো এগিয়ে থাকার বড় কারণ আদতে বিরোধী পক্ষগুলোর বিভাজন, যাকে আরও বড় করে তোলার রাজনীতিই করছে বিজেপি। রাজনীতি হিসেবে বিপরীত পক্ষকে খর্বশক্তি করার চেষ্টা চালানো দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই চেষ্টায়, এই বিভাজনের খেলায় যখন জনবহুল একটি দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকেই জড়িয়ে ফেলা হয়, তখন তৈরি হয় আশঙ্কা। নিরাপত্তাসহ যে বিভিন্ন খেলা বিজেপি এখন খেলছে, তা এই বিপদই সামনে নিয়ে আসছে। সে যা-ই হোক, ভারতে একটি নির্বাচন হচ্ছে, যেখানে ভোট দিচ্ছেন ৯০ কোটিরও বেশি ভোটার। তামাশাটা হচ্ছে, এই ভোটারদের এমন দুই পক্ষের এক পক্ষকে বেছে নিতে হবে, যার একটি ‘বিভাজিত ও সারহীন’, আর অন্যটি ‘নিজে ছাড়া বাকি সবাইকেই গাধা’ বলে মনে করে। এই দুই পক্ষের একটিকেই ভোট দেবেন এবং দিচ্ছেন ভারতীয় জনতা। সান্ত্বনা এই যে তাঁরা ভোট দিতে পারছেন। ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই বিকল্প বেছে নেওয়ার এই ক্ষমতাই আপাতত ভারতে গণতন্ত্রের সার্থকতা।