জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদি সরকার ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দেশজুড়ে কে দেশপ্রেমিক ও কে দেশবিরোধী, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছে।
জেএনইউয়ের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূত্রপাত, তা কিন্তু নতুন কিছু নয়। ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আফজল গুরুর ফাঁসির পর থেকে প্রতিবছরই ওই দিন কাশ্মীরে ও কাশ্মীরের বাইরে কিছু জায়গায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। জেএনইউতে সেটাই হয়েছিল। যেহেতু কেন্দ্রে এখন মোদি সরকার, তাই বিজেপির ছাত্রসংগঠন এবিভিপি অনেক সক্রিয়। তারা প্রতিবাদ করায় উত্তেজনা বাড়ে এবং কিছু উত্তেজিত ছাত্র দেশবিরোধী স্লোগান দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। তারপরই আসরে নেমে পড়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংঘ পরিবারের লোকজন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তারপর আদালতে তোলার সময় দেশভক্ত আইনজীবীরা যেভাবে তাঁর ওপর হামলা চালায়, তা টিভির সুবাদে সবারই দেখা। জেএনইউর ঘটনায় ছাত্রদের সমর্থনে এবং বিজেপির বিকৃত দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, রাজনৈতিক জগতে। সংসদেও এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে।
বিজেপি ও সংঘ পরিবারের বক্তব্য স্পষ্ট, ভারতে বসে যদি কেউ ভারতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার কথা বলে (কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি, মণিপুর মাঙ্গে আজাদি, নাগাল্যান্ড মাঙ্গে আজাদি, ইত্যাদি), তাহলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে শাস্তি পেতেই হবে। বিরোধী দলের অনেকে বিতর্কে অংশ নিয়ে বলছেন, যাঁদের ধরা হয়েছে, জেএনইউর সেই ছাত্রনেতারা এসব কথা বলেননি। তাঁদের ছেড়ে দিতে যাঁরা বলেছেন, তাঁদের ধরে বিচার করা যেতে পারে।
এসব কথার মধ্যে মূল প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা রয়েছে। বলা হচ্ছে না, ভারতীয় দণ্ডবিধির যে ধারার আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে সাজার কথা বলা আছে, সেই ১২১ ধারা তৈরিই হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সরিয়ে দিয়ে কুইন ভিক্টোরিয়াকে ভারতসম্রাজ্ঞী করে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। তারপর ১৮৬০ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের বিরুদ্ধে ওই ধারাগুলো ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যোগ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালে ওই আইনের ধারাগুলো থেকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ও ইংল্যান্ডের রানির উল্লেখ বাদ দিয়ে মূল ধারাটি হুবহু রেখে দেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই রাষ্ট্রদ্রোহের ধারাটি আইনে এখনো রাখা উচিত কি না, সেই প্রশ্নই এখন সামনে উঠে আসতে বাধ্য। কারণ, এত বড় দেশে সমাজের বহু অংশ নানা সময় নানা কারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের এলাকাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই পারে। তাদের ক্ষোভ নিরসনে আলাপ-আলোচনা চালানো দরকার, যাতে ওই সব ক্ষোভের প্রকাশ গণতান্ত্রিক পরিসরের মধ্যেই সীমিত থাকে। তা না করে ঔপনিবেশিক আইনের আশ্রয় নিয়ে দমনপীড়ন করলে যে সেসব ক্ষোভই বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যায়, সে কথা রাষ্ট্রের পরিচালকেরা বুঝতে চাইছেন না। তবে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের এই অবস্থান কতটা নীতিগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, আফজল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদে কাশ্মীরে যারা এখনো সোচ্চার, তাদের অন্যতম পিডিপি দল। বিজেপি তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে সেখানে এত দিন সরকারে ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাঈদের মৃত্যুর পরে আবারও তাদের সঙ্গেই নতুন করে জোট বাঁধার তোড়জোড় চলছে।
সমস্যার সমাধানে শুধু কৌশলগত অবস্থান নয়, রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থানটিও স্পষ্ট হওয়া দরকার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত যত বেশি মজবুত, সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও তত বেশি হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে জেএনইউর ধৃত ছাত্রকে আদালত প্রাঙ্গণেই মারধর করে একশ্রেণির আইনজীবী নিজেদের ভারতমাতার প্রকৃত সন্তান বলে দাবি করছেন। সংঘ পরিবারের নেতারাও ভারতমাতার অপমানের বদলা নিতে জেএনইউর পাশে দাঁড়ানো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে ঢুকে লাথি মারতে মারতে ধরে আনার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। ভারতমাতার অবমাননায় ক্রুদ্ধ এই দেশভক্তরা দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা তৈরির চেষ্টা করছেন, সেটাই একমাত্র সংজ্ঞা হওয়া উচিত কি না, তা নিয়েও বিতর্ক হওয়া উচিত।
>দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা বিজেপি ও সংঘ পরিবার তৈরি করতে সচেষ্ট, তা নতুন নয়। অন্ধ দেশভক্তি ও অন্ধ মোহ যে আদতে দেশের ভাবমূর্তিই মলিন করে, সে ব্যাপারে অনেক আগেই সতর্ক করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথমত, দেশ থেকে বেরিয়ে বা আলাদা হয়ে গিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার বহু নজির রয়েছে। তা ঠেকাতে শাসকগোষ্ঠী অনেক সময়ই বলপ্রয়োগ করেছে, কখনো সফল হয়েছে, কখনো হয়নি। বাংলাদেশের জন্মই তো হয়েছে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। গত ১০০ বছরে ইউরোপের মানচিত্র বহুবার পাল্টেছে, একেকটা দেশ ভেঙে নতুন নতুন দেশ জন্ম নিয়েছে। কখনো তা চেষ্টা করেও পারেনি। যেমন ২০১৪ সালে গ্রেট ব্রিটেন বা ইউনাইটেড কিংডম থেকে স্কটল্যান্ডের আলাদা হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। স্কটল্যান্ডের ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অনেক বছরের আন্দোলনের পরে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্কটল্যান্ডে এই বিষয়ে গণভোট হয়। ইউনাইটেড কিংডম বা ইংল্যান্ড থেকে আলাদা হওয়ার প্রশ্নে ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ বলতে বলা হয়। তাতে বিপুল সাড়া মেলে, প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ ভোটে অংশ নেন। ইংল্যান্ড থেকে আলাদা হওয়ার প্রশ্নে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘না’ জেতে, ‘হ্যাঁ’ হেরে যায়। ৫৫ শতাংশ মানুষ ইংল্যান্ডের সঙ্গে থেকে যাওয়ার পক্ষে রায় দেন, ৪৪ শতাংশ মানুষ আলাদা হওয়ার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু দেশকে টুকরো টুকরো করার পক্ষে মত প্রকাশের জন্য কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়নি, তাঁদের দেশদ্রোহী তকমাও জোটেনি। গণতান্ত্রিক পরিসরে বিরুদ্ধ মতের প্রতি যে মর্যাদা দেখানো উচিত, সেটাই দেখানো হয়েছে।
দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা বিজেপি ও সংঘ পরিবার তৈরি করতে সচেষ্ট, তা নতুন নয়। অন্ধ দেশভক্তি ও অন্ধ মোহ যে আদতে দেশের ভাবমূর্তিই মলিন করে, সে ব্যাপারে অনেক আগেই সতর্ক করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ১৯০৮ সালে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে চিঠিতে লিখেছেন, দেশপ্রেম কখনোই আমাদের আত্মার শেষ আশ্রয় হতে পারে না। তিনি বরং মানবতাবাদকেই আঁকড়ে ধরতে আগ্রহী। তাঁর ঘরে-বাইরে উপন্যাসে তিনি এই দেশভক্তি ও দেশপ্রেমের বিষয়টির মোকাবিলা করেছেন। ঘরে-বাইরে উপন্যাসের অন্যতম মূল চরিত্র নিখিলেশের মুখে রবীন্দ্রনাথ নিজের কথা বসিয়ে বলছেন, ‘দেশকে সাদাভাবে সত্যভাবে দেশ বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলে শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চিৎকার করে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি। সত্যেরও উপরে কোনো-একটা মোহকে প্রবল করে রাখার চেষ্টা এ আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের লক্ষণ।’
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘টেগোর অ্যান্ড হিজ ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন, তিনি এসবের ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে সত্যকে আরও গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। বলাই বাহুল্য, আজ বিজেপি যে দেশপ্রেমের কথা বলছে, তা রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। সে কথাই মনে করিয়ে দিয়ে লোকসভার বিতর্কে সুগত বসু (নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্রের নাতি) মন্তব্য করেন, আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তাঁকেও হয়তো ‘দেশবিরোধী’ তকমা দেওয়া হতো।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।