নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তার দ্বিতীয় মেয়াদের ১০০ দিন পূর্ণ করেছে। তাঁর সরকারের দুর্বল রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও মোদি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ কোনো লক্ষণ নয়।
মোদি সরকারের সমর্থকেরা মুসলমানদের ‘তিন তালাক’ প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে নতুন আইন অনুমোদনসহ বেশ কয়েকটি দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। একইভাবে মোদি সরকার সম্প্রতি সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি গোটা রাজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয়েছে। গোটা রাজ্য এখন একটি প্রেশারকুকার। কেউ এই প্রেশারকুকারের ঢাকনা সরিয়ে নিলে কী হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তারপরও বেশির ভাগ ভারতীয় মোদিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
মোদির এই জনপ্রিয়তা তাঁর সমালোচকদের জন্য বিভ্রান্তিকর। তিনি দেশের কল্যাণের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, এর বেশির ভাগই জনগণের ভালোর চেয়ে ক্ষতি করেছে বেশি। ২০১৬ সালে নোটবন্দীর সিদ্ধান্ত তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি ছিল ভারতের অর্থনীতির ওপর একটি বড় আঘাত। ভারতের স্বাধীনতার পর সম্ভবত আর কোনো একক ঘটনা এভাবে অর্থনীতিতে ধস নামায়নি। এতে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। তবে এই ঘটনা বেশির ভাগ ভোটারকে অসুবিধায় ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে না। তাঁদের কাছে মোদি বাজে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হননি। বরং তাঁদের কাছে তিনি এমন একজন নেতা, যিনি ঐতিহ্যকে ভেঙে দিতে পারেন এবং ভারতের দুর্দমনীয় সমস্যাগুলো সমাধানে সাহসী উদ্যোগ নিতে পারেন। মোদির এসব কর্মকাণ্ডে ভারতের অনেকের মাথায় হাত পড়েছে। এখানে এমন একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, যিনি কার্যতই ভারতীয় রাজনীতির প্রতিটি শান্তির সনদের অবসান ঘটিয়েছেন। তিনি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার জন্য। তিনি সেই সব মন্ত্রীকে পদোন্নতি দিয়েছেন, যাঁদের বিভেদমূলক বক্তৃতার কারণে মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুরা ভীতির মধ্যে রয়েছে এবং গণমাধ্যমকে এমন ভয় দেখিয়েছেন যে তাঁর প্রশাসনের কোনো খবর প্রকাশ করা ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য বিব্রতকর।
তার ওপর মোদি সরকার সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ার পদে (যে পদে আগে আমি ছিলাম) প্রধান বিরোধী দলের সদস্যকে রাখার যে ঐতিহ্য এত দিন ধরে বহাল ছিল, তা বাতিল করেছে। এর পরিবর্তে মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা নিজ সরকারের কাছে জবাবদিহি করবে। মোদির অনেক ভক্তের জন্য এ–জাতীয় উগ্র ও কর্তৃত্ববাদী প্রদর্শনগুলো কোনো বিষয় নয়। তাদের দৃষ্টিতে কয়েক দশক ধরে অনেক বেশি ‘নরম মনের গণতন্ত্র’–এর পর এ রকম একজন ‘কঠোর’ ভারতীয় নেতার দরকার ছিল। আমাদের মধ্যে যাদের ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল, তারা এখন এই উপলব্ধির মুখোমুখি যে এর মূলগুলো যতটা গভীরে প্রোথিত বলে আমরা মনে করতাম, আসলে ততটা গভীরে নয়।
দেশের প্রায় প্রতিটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ফাঁপা হয়ে গেছে এবং পরিণত হয়েছে সরকারের অতিরিক্ত কর্তৃত্বের একটি উপকরণ হিসেবে। এমনকি নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের মতো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো এর বাইরে নয়। মোদির অধীনে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে আর পুণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সামাজিক শৃঙ্খলার নতুন মান হলো নিয়ন্ত্রণ (কর্তৃপক্ষের) ও আনুগত্য।
বিজেপি শাসনের অধীনে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে আরও খারাপ হয়েছে। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা এত মারাত্মক যে এমনকি সরকারের কট্টর সমর্থকদের কেউ কেউ এটি স্বীকারও করেছেন। তিন হাজার বছর ধরে ভারত জাতিগত ও ধর্মবিশ্বাসের কারণে নিপীড়িতদের আবাসস্থল ছিল। আজ এটি মিয়ানমার থেকে আসা মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একটি জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করেছে, যা লাখ লাখ মুসলিম এবং ভারতে জন্মানো তাদের শিশুদের বাদ দিয়েছে।
আমার মতো উদার গণতান্ত্রিকদের কাছে যে বিষয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে সেটা হচ্ছে বিজেপির দক্ষ প্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণ বিপথগামী হতে পারে। যেমনটি পণ্ডিত ও ভাষ্যকার প্রতাপ ভানু মেহতা সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কোনোভাবে কি এই নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয়তাবাদের এই উত্থান আমাদের নিজস্ব গভীর আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল?’ যাহোক, মোদির দ্বিতীয় পাঁচ বছরের মেয়াদে যদি এই প্রথম ১০০ দিনের কোনো ইঙ্গিত থাকে, তবে ভারত খুব শিগগির সেই দেশে পরিণত হতে পারে, যে দেশটিকে মুক্ত করার জন্য মহাত্মা গান্ধী সংগ্রাম করেছিলেন।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী